Social Icons

রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

দুঃখ করো না, বাঁচো - নির্মলেন্দু গুণ

দুঃখকে স্বীকার করো না, –সর্বনাশ হয়ে যাবে ।
দুঃখ করো না, বাঁচো, প্রাণ ভ’রে বাঁচো ।
বাঁচার আনন্দে বাঁচো । বাঁচো, বাঁচো এবং বাঁচো ।
জানি মাঝে-মাঝেই তোমার দিকে হাত বাড়ায় দুঃখ,
তার কালো লোমশ হাত প্রায়ই তোমার বুক ভেদ করে
চলে যেতে চায়, তা যাক, তোমার বক্ষ যদি দুঃখের
নখরাঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়; যদি গলগল করে রক্ত ঝরে,
তবু দুঃখের হাতকে তুমি প্রশ্রয় দিও না মুহূর্তের তরে ।
তার সাথে করমর্দন করো না, তাকে প্রত্যাখান করো ।

অনুশোচনা হচ্ছে পাপ, দুঃখের এক নিপুণ ছদ্মবেশ ।
তোমাকে বাঁচাতে পারে আনন্দ । তুমি তার হাত ধরো,
তার হাত ধরে নাচো, গাও, বাঁচো, ফুর্তি করো ।
দুঃখকে স্বীকার করো না, মরে যাবে, ঠিক মরে যাবে ।

যদি মরতেই হয় আনন্দের হাত ধ’রে মরো ।
বলো, দুঃখ নয়, আনন্দের মধ্যেই আমার জন্ম,
আনন্দের মধ্যেই আমার মৃত্যু, আমার অবসান ।

মোনালিসা - নির্মলেন্দু গুণ

চোখ বন্ধ করলে আমি দেখতে পাই
সদ্য-রজঃস্বলা এক কিশোরীরে−
যে জানে না, কী কারণে হঠাৎ এমন
তীব্র তুমুল আনন্দ-কাতরতা
ছড়িয়ে পড়েছে তার নওল শরীরে।

মনুর ভাষায় গৌরী, এইটুকুনু মেয়ে
চমকে ওঠে নিজের পানে চেয়ে−
দেখে তার অঙ্গজুড়ে ফুলের উৎসব।
মনে হয় ছড়িয়ে পড়েছে মর্ত্যে
নার্গিস আর বার্গিসের স্বর্গপুষ্পঘ্রাণ।
মাকে ডেকে মেয়েটি শুধায়−
‘আমার শরীরে ফুলের সৌরভ কেন?
মেয়েরা বুঝি ফুলের উদ্যান?’

মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে মা বলেন,
‘বোকা মেয়ে, কিচ্ছু বোঝে না, −আয়,
আজ আমি কুসুমগরমজলে
তোকে নিজ হাতে গোসল করাব।’
মা’র বুকে মাথা পেতে মেয়েটি তখন
নিজেই কখন যেন মা হয়ে যায়।

এই লাভাস্রোত, এই সঙ্গকাতরতা
তাকে শেষে কোথায় ভাসিয়ে নেবে
জানে না সে; বোঝে না সে
তার বৃক্ষপত্রে কার হাওয়া লাগে?
অগ্নিকুণ্ডে বায়ুর মতন ছুটে এসে
কে তাকে জড়াবে আদরে, সোহাগে?

জানে না সে, বোঝে না সে তার চোখে,
ঠোঁটে, তলপেটে, ঘুমভাঙা স্তনে
জেগেছে যে ঢেউ তার গন্তব্য কোথায়?
আনন্দ পুরুষে? নাকি আনন্দ সন্তানে?

এইসব দেহতত্ত্ব জানার আগেই,
এইসব গূঢ় গোপন রহস্যভেদ
হওয়ার আগেই
আষাঢ়ের এক বৃষ্টিভেজা রাতে
মোনালিসার বিয়ে হয়ে গেল−
লিওনার্দো দা ভিঞ্চির সাথে।

লিওনার্দো অতঃপর দীর্ঘ রাত্রি জেগে
জীবনের শেষ রং দিয়ে
তাঁর প্রিয়তমা তরুণী ভার্যা
মোনালিসাকে ক্যানভাসে আঁকলেন।

শিল্পের ঔরসে মোনালিসা গর্ভবতী হলে
স্বর্গ থেকে মখলুকাতে পুষ্পবৃষ্টি হলো।
সিন্ধুর বিজয়রথ পশিল নদীতে−
শান্ত হলো ক্ষিপ্তোন্মত্ত সমুদ্রের জল।

মোনালিসা, য়ুরোপের প্রথম রমণী−
পুরুষের কাণ্ড দেখে হাসে।

শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

শেষ হ'ল জীবনের সব লেনদেন - জীবনানন্দ দাশ

শেষ হ'ল জীবনের সব লেনদেন,
বনলতা সেন।
কোথায় গিয়েছ তুমি আজ এই বেলা
মাছরাঙা ভোলেনি তো দুপুরের খেলা
শালিখ করে না তার নীড় অবহেলা
উচ্ছ্বাসে নদীর ঢেউ হয়েছে সফেন,
বনলতা সেন।

তোমার মতন কেউ ছিল কী কোথাও?
কেন যে সবের আগে তুমি চলে যাও।
কেন যে সবের আগে তুমি
পৃথিবীকে করে গেলে শূন্য মরুভূমি
(কেন যে সবার আগে তুমি)
ছিঁড়ে গেলে কুহকের ঝিলমিল টানা ও পোড়েন,
কবেকার বনলতা সেন।

কত যে আসবে সন্ধ্যা প্রান্তরে আকাশে,
কত যে ঘুমিয়ে রবো বস্তির পাশে,
কত যে চমকে জেগে উঠবো বাতাসে,
হিজল জামের বনে থেমেছে বুঝি রাত্রির ট্রেন,
শেষ হ'ল জীবনের সব লেনদেন।

শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

আকাশ - নির্মলেন্দু গুণ

আমার সমস্ত ভাবনা যখন তোমাকে ছোঁয়,
আমার সমস্ত উপলব্ধি যখন তোমার
আত্মাকে স্পর্শ করে, আমার সমস্ত বোধ
যখন তোমার বোধিতে নিমজ্জিত হয়,
তখন আমার প্রাণের গভীর থেকে
স্বতঃস্ফূর্ত মোহন মন্ত্রের মতো উচ্চারিত হয়
একটি অত্যন্ত সহজ শব্দ…"আকাশ"।

আমি শব্দটিকে ক্রমাগত উচ্চারণ করি।
জানি না কেন এ শব্দটিই শুধু
এত বারবার ঘুরে ঘুরে আসে।
জানি না কী পেয়েছে সে আমার ভিতরে?
আমি লক্ষ্য করেছি, ‘আকাশ’ শব্দটি
উচ্চারিত হওয়ার পরে আমার ভিতরে
আর কোন কষ্টই অবশিষ্ট থাকে না।
যেন যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বুলেটের মতো
আমার বুকের ভিতরে গেঁথে ছিল
এই যন্ত্রণাক্ত  আকাশ  শব্দটি।

তোমার আমার মাঝে আছে এরকম
বক্ষফাটা অনেক আকাশ । – আমি
ব্যর্থ প্রেমিকের মতো মুগ্ধমূর্খচোখে
কেবল তাকিয়ে থাকি আকাশের দিকে।

পূর্ণিমার মধ্যে মৃত্যু - নির্মলেন্দু গুণ

একদিন চাঁদ উঠবে না, সকাল দুপুরগুলো
মৃতচিহ্নে স্থির হয়ে রবে;
একদিন অন্ধকার সারা বেলা প্রিয় বন্ধু হবে,
একদিন সারাদিন সূর্য উঠবে না।

একদিন চুল কাটতে যাব না সেলুনে
একদিন নিদ্রাহীন চোখে পড়বে ধুলো।
একদিন কালো চুলগুলো খ’সে যাবে,
কিছুতেই গন্ধরাজ ফুল ফুটবে না।

একদিন জনসংখ্যা কম হবে এ শহরে,
ট্রেনের টিকিট কেটে
একটি মানুষ কাশবনে গ্রামে ফিরবে না।
একদিন পরাজিত হবো।

একদিন কোথাও যাব না, শূন্যস্থানে তুমি
কিম্বা অন্য কেউ বসে থেকে বাড়াবে বয়স।
একদিন তোমাকে শাসন করা অসম্ভব ভেবে
পূর্ণিমার রাত্রে মরে যাব।

একদিন সারাদিন কোথাও যাব না।

উপেক্ষা - নির্মলেন্দু গুণ

অনন্ত বিরহ চাই, ভালোবেসে কার্পণ্য শিখিনি।
তোমার উপেক্ষা পেলে অনায়াসে ভুলে যেতে পারি
সমস্ত বোধের উৎস গ্রাস করা প্রেম; যদি চাও
ভুলে যাবো, তুমি শুধু কাছে এসে উপেক্ষা দেখাও।

আমি কি ডরাই সখি, ভালোবাসা ভিখারি বিরহে?

শাঁখা - নির্মলেন্দু গুণ

আমি তোমাকে শাঁখা দিতে চাইলাম
তুমি চাইলে অর্থহীন সোনার কাকন।

আমি তোমাকে সংসার দিতে চাইলাম,
তুমি চাইলে সুসজ্জিত স্তব্ধ আকাশ।

আমি তোমাকে সন্তান দিতে চাইলাম,
তুমি চাইলে বাস্তবের বিদীর্ণ পলাশ।

আমি তোমাকে স্বপ্ন দিতে চাইলাম,
তুমি ঘুমের ওষুধ কিনে নিলে।

যাত্রাভঙ্গ - নির্মলেন্দু গুণ

হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে
মন বাড়িয়ে ছুঁই,
দুইকে আমি এক করি না
এক কে করি দুই।

হেমের মাঝে শুই না যবে,
প্রেমের মাঝে শুই
তুই কেমন করে যাবি?
পা বাড়ালেই পায়ের ছায়া
আমাকেই তুই পাবি।

তবুও তুই বলিস যদি যাই,
দেখবি তোর সমুখে পথ নাই।

তখন আমি একটু ছোঁব
হাত বাড়িয়ে জড়াব তোর
বিদায় দুটি পায়ে,
তুই উঠবি আমার নায়,
আমার বৈতরণী নায়।

নায়ের মাঝে বসবো বটে,
না-এর মাঝে শোবো,
হাত দিয়েতো ছোঁব না মুখ
দুঃখ দিয়ে ছোঁব।

তুই কেমন করে যাবি?