Social Icons

শুক্রবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

এই অরণ্যে - সেতু আশরাফুল হক

মৃত্তিকা; মা আমাদের। হাজার বছরের ধর্ষিত, পদদলিত এক দাসী। আর যারা তার জারজ সন্তান, আত্মমুগ্ধ আদিমতাবোধে ইতিহাসের পাতায় নিজেকে করেছে ইডিপাসের মতো। তারা মত্ত, উলঙ্গ হয়ে খুবলে খেয়ে নিচ্ছে নিজ জননীকে। সভ্যতা থেকে আজ অনেক দূরে এই আদিম বনে আমরাও যেন ভীত কোকিল পাখি।
কত দীর্ঘ স্বর পেরিয়ে আমাদের চিৎকার শুধু নিজেকেই পরিহাস করছে। বাসন্তীর যৌবনে জড়িয়েছে জাল, আজো সে ক্রন্দসী। বোন আমার, তাকে আবার জাল দাও অথবা ফেরী করে বেড়াও কতগুলো ন্যুড ছবি।
কিশোর ভাই, তার ঝলসানো মাংসের কাবাব তুলে দাও দেবতাদের ডাইনিং টেবিলে। সদ্য-তাজা-ভাপ ওঠা পোড়া মাংসের স্বাদ পেতে তারা উদগ্রীব।
আমাদের এই অরণ্যে লুকোনোর জায়গা শেষ হয়ে গেছে। তবু জারজের উল্লম্ফন দেখে দেখেও আমাদের বোধোদয় ঘটেনি। আমরা কেবল তুলে দিচ্ছি নিজেকেই প্রকাণ্ড সিংহের গুহায়।

বুধবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

বিদ্রোহী - কাজী নজরুল ইসলাম

বল বীর-
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারী' আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রীর!
বল বীর-

বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি'
চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারা ছাড়ি'
ভূলোক দ্যূলোক গোলোক ভেদিয়া
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!
মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!

বল বীর-
আমি চির-উন্নত শির!

আমি চিরদুর্দম, দূর্বিনীত, নৃশংস,
মহাপ্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস!
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর,
আমি দূর্বার,
আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!
আমি মানি না কো কোন আইন,
আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!
আমি ধূর্জটী, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর
আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব-বিধাতৃর!

বল বীর-
চির-উন্নত মম শির!

আমি ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণি,
আমি পথ-সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’।
আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ,
আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ।
আমি হাম্বীর, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল,
আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’
পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’
ফিং দিয়া দেই তিন দোল্‌;
আমি চপোলা-চপোল হিন্দোল।
আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা’,
করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা,
আমি উন্মাদ, আমি ঝঞ্ঝা!
আমি মহামারী, আমি ভীতি এ ধরীত্রির;
আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ণ চির অধীর।

বল বীর-
আমি চির-উন্নত শির!

আমি চির-দূরন্ত দুর্মদ
আমি দূর্দম মম প্রাণের পেয়ালা হর্দম্‌ হ্যায় হর্দম্‌ ভরপুর্‌ মদ।
আমি হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক জমদগ্নি,
আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি।
আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,
আমি অবসান, নিশাবসান।

আমি ঈন্দ্রাণী-সুত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ তূর্য;
আমি কৃষ্ণ-কন্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা বারিধির।
আমি ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর।

বল বীর-
চির-উন্নত মম শির!

আমি সন্ন্যাসী, সুর সৈনিক,
আমি যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক।
আমি বেদুইন, আমি চেঙ্গিস,
আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কূর্ণিশ।
আমি বজ্র, আমি ঈষাণ-বিষানে ওঙ্কার,
আমি ইস্রাফিলের শৃঙ্গার মহা-হুঙ্কার,
আমি পিনাক-পাণির ডমরু ত্রিশুল, ধর্মরাজের দন্ড,
আমি চক্র-মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচন্ড!
আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা, বিশ্বামিত্র-শিষ্য,
আমি দাবানল-দাহ, দহন করিব বিশ্ব।
আমি প্রাণ-খোলা হাসি উল্লাস, -আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস
আমি মহাপ্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু-গ্রাস!
আমি কভু প্রশান্ত, -কভু অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী,
আমি অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্পহারী!
আমি প্রভঞ্জনের উচ্ছাস, আমি বারিধির মহাকল্লোল,
আমি উজ্জ্বল, আমি প্রোজ্জ্বল,
আমি উচ্ছল জল-ছল-ছল, চল ঊর্মির হিন্দোল-দোল!-

আমি বন্ধনহারা কুমারীর বেনী, তন্বী নয়নে বহ্নি,
আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি!

আমি উন্মন, মন-উদাসীর,
আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর।
আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির গৃহহারা যত পথিকের,
আমি অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা, প্রিয় লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের
আমি অভিমানী চির ক্ষূব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যাথা সূনিবিড়,
চিত চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর থর থর প্রথম পরশ কুমারীর!
আমি গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল ক’রে দেখা অনুখন,
আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা, তাঁর কাঁকণ-চুড়ির কন্‌-কন্‌।
আমি চির শিশু, চির কিশোর,
আমি যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচর কাঁচুলি নিচোর!
আমি উত্তর-বায়ু মলয়-অনিল উদাস পূরবী হাওয়া,
আমি পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীণে গান গাওয়া।
আমি আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র-রুদ্র রবি
আমি মরু-নির্ঝর ঝর-ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়াছবি!
আমি তুরীয়ানন্দে ছুটে চলি, এ কি উন্মাদ আমি উন্মাদ!
আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!

আমি উত্থান, আমি পতন, আমি অচেতন চিতে চেতন,
আমি বিশ্বতোরণে বৈজয়ন্তী, মানব-বিজয়-কেতন।
ছুটি ঝড়ের মতন করতালী দিয়া
স্বর্গ মর্ত্য-করতলে,
তাজী বোর্‌রাক্‌ আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার
হিম্মত-হ্রেষা হেঁকে চলে!
আমি বসুধা-বক্ষে আগ্নেয়াদ্রী, বাড়ব বহ্নি, কালানল,
আমি পাতালে মাতাল, অগ্নি-পাথার-কলরোল-কল-কোলাহল!
আমি তড়িতে চড়িয়া, উড়ে চলি জোড় তুড়ি দিয়া দিয়া লম্ফ,
আমি ত্রাস সঞ্চারি’ ভুবনে সহসা, সঞ্চারি ভূমিকম্প।

ধরি বাসুকির ফণা জাপটি’-
ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি’।

আমি দেবশিশু, আমি চঞ্চল,
আমি ধৃষ্ট, আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্ব-মায়ের অঞ্চল!
আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরী,
মহা-সিন্ধু উতলা ঘুম্‌ঘুম্‌
ঘুম্‌ চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝ্‌ঝুম
মম বাঁশরীর তানে পাশরি’।
আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী।

আমি রুষে উঠি’ ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া,
ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোযখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া!
আমি বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া!

আমি শ্রাবণ-প্লাবন-বন্যা,
কভু ধরনীরে করি বরণীয়া, কভু বিপুল ধ্বংস ধন্যা-
আমি ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা!
আমি অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি,
আমি ধূমকেতু জ্বালা, বিষধর কাল-ফণী!
আমি ছিন্নমস্তা চন্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী,
আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি!

আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময়,
আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়!
আমি মানব দানব দেবতার ভয়,
বিশ্বের আমি চির-দুর্জয়,
জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,
আমি তাথিয়া তাথিয়া মাথিয়া ফিরি স্বর্গ-পাতাল মর্ত্য!
আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!!
আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!!

আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার
নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার!
আমি হল বলরাম-স্কন্ধে,
আমি উপাড়ি’ ফেলিব অধিন বিশ্ব অবহেলে, নব সৃষ্টির মহানন্দে

মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না-
অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।

আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন,
আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন!
আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!

আমি চির-বিদ্রোহী বীর-
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!

সোমবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

বৃষ্টিবিলাস - চৌধুরী ফাহাদ

তোমাকে ছুঁয়ে দেখবো বলে...
মাড়িয়ে এসেছি মুক্তোদানা পথে,
সোনালী শিহরণ,
পেরিয়ে এসেছি অবারিত আকর্ষণ,
হেমন্ত আবরণ।
কণকণে মাদলে অপেক্ষা করেছি
সহস্র শৈত্যপ্রতাপ,
ছাড়িয়ে এসেছি কুয়াশা আলিঙ্গন
সোনা রোদ্দুরে সোনা আহ্বান।
তোমাকে ছুঁয়ে দেখবো বলে...
পাড়ি দিয়েছি অজস্র ফাগুণের বন,
ঘুরেছি শত বসন্ত বাগান।
তোমাকে ছুঁয়ে দেখবো বলে...
আকণ্ঠ তৃষ্ণায় অনন্তকাল
দাঁড়িয়ে রয়েছি গ্রীষ্ম শহরে।

অবশেষে তুমি এলে।
তুমি এলে ছেড়ে মেঘমাল্লার শ্বাস,
আকাশের ওপারে আকাশ।
আকাঙ্ক্ষার অনু বর্ষণে ছুঁয়ে দিলে
তপ্ত কপোলের ঢাল,
ছুঁয়ে দিলে অপেক্ষা পাহাড়।
তোমার স্মিত সুহাস আলিঙ্গনে,
ছুঁয়ে দিলে প্রিয়তমাসু মন।

ভালোবাসবো ...রত্নদীপা দে ঘোষ

এতো ভালবাসবো তোমাকে যে
ঠিক সূর্য ওঠার সময়
একটার পর একটা চুমু
ঝমঝম করবে সরোবরে , দোয়েল পাখি
শিস দেবে ক্রমাগত , ভাসবে পালক
চেটেপুটে সূর্যালোক উড়বে
মিহি কারুকাজে ! ক্লান্তি তে ঠোঁটে নামবে বিকেল ,
হাই তুলবে
মোরগঝুঁটি ফুল ,
এতো ভালবাসবো তোমাকে ...

মাঝরাতে ঘুম না এলে
কোনো কোনো দিন , বখাটে চাঁদ টা সম্পূর্ণ
লোপাট হয়ে যায় মিসিসিপি তে ,
রক্ত চলাচলে বাধা পরে আমার , তুমি
ঐ শালপাইনের জঙ্গলে যেও না আর !
এমন মৃত্যুর পর
আমি যেন ঝরনার সাথে
লুকোচুরি খেলি !

আজ রাতে
যখন জানালামুখো আকাশে
উঠবে চাঁদ , নাভিতে তামাম কোলাহল ,
তখন
এতো ভালবাসবো তোমাকে ...
এতো ভালবাসবো ...যে
আমাকে ইশ্বর বলে মনে হবে ......

সত্যবদ্ধ অভিমান - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
আমি কি এ হাতে কোনো পাপ করতে পারি ?
শেষ বিকেলের সেই ঝুল বারান্দায়
তার মুখে পড়েছিল দুর্দান্ত সাহসী এক আলো
যেন এক টেলিগ্রাম, মুহূর্তে উন্মুক্ত করে
নীরার সুষমা
চোখে ও ভুরুতে মেশা হাসি, নাকি অভ্রবিন্দু ?
তখন সে যুবতীকে খুকি বলে ডাকতে ইচ্ছে হয়--
আমি ডান হাত তুলি, পুরুষ পাঞ্জার দিকে
মনে মনে বলি,
যোগ্য হও, যোগ্য হয়ে ওঠো--
ছুঁয়ে দিই নীরার চিবুক
এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
আমি কি এ হাতে আর কোনোদিন
পাপ করতে পারি ?

এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে , ভালোবাসি--
এই ওষ্ঠে আর কোনো মিথ্যে কি মানায় ?
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনে পড়ে ভীষণ জরুরী
কথাটাই বলা হয়নি
লঘু মরালীর মতো নারীটিকে নিয়ে যাবে বিদেশী বাতাস
আকস্মিক ভূমিকম্পে ভেঙ্গে যাবে সবগুলো সিঁড়ি
থমকে দাঁড়িয়ে আমি নীরার চোখের দিকে....
ভালোবাসা এক তীব্র অঙ্গীকার, যেন মায়াপাশ
সত্যবদ্ধ অভিমান--চোখ জ্বালা করে ওঠে,
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে, ভালোবাসি--
এই ওষ্ঠে আর কোন মিথ্যে কি মানায় ?

নির্জন স্বাক্ষর - জীবনানন্দ দাশ

তুমি তা জানো না কিছু, না জানিলে-
আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য ক’রে!
যখন ঝরিয়া যাব হেমন্তের ঝড়ে,
পথের পাতার মতো তুমিও তখন
আমার বুকের ‘পরে শুয়ে রবে?
অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন
সেদিন তোমার!
তোমার এ জীবনের ধার
ক্ষয়ে যাবে সেদিন সকল?
আমার বুকের ’পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল,
তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই!-
শুধু তার স্বাদ
তোমারে কি শান্তি দেবে!
আমি ঝরে যাব, তবু জীবন অগাধ
তোমারে রাখিবে ধরে সেইদিন পৃথিবীর’ পরে-
আমার সকল গান ও তবুও তোমারে লক্ষ্য ক’রে!

রয়েছি সবুজ মাঠে-ঘাসে-
আকাশ ছড়ায়ে আছে নীল হয়ে আকাশে আকাশে।
জীবনের রঙ তবু ফলানো কি হয়
এই সব ছুঁয়ে ছেনে!-সে এক বিস্ময়
পৃথিবীতে নাই তাহা – আকাশেও নাই তার স্থল-
চেনে নাই তারে অই সমুদ্রের জল!
রাতে রাতে হেঁটে হেঁটে নক্ষত্রের সনে
তারে আমি পাই নাই, কোনো এক মানুষীর মনে
কোনো এক মানুষের তরে
যে জিনিস বেঁচে থাকে হৃদয়ের গভীর গহ্বরে!-
নক্ষত্রের চেয়ে আরো নিঃশব্দে আসনে
কোনো এক মানুষের তরে এক মানুষীর মনে!

একবার এথা ক’য়ে দেশ আর দিকের দেবতা
বোবা হয়ে পড়ে থাকে–ভুলে যায় কথা!
যে-আগুন উঠেছিল তাদের চোখের তলে জ্ব’লে
নিভে যায় — ডুবে যায় — তারা যায় স্খ’লে!
নতুন আকাঙক্ষা আসে — চলে আসে নতুন সময়
পুরনো সে নক্ষত্রের দিন শেষ হয়,
নতুনেরা আসিতেছে ব’লে!–
আমার বুকের থেকে তবুও কি পড়িয়াছে স্খ’লে
কোনো এক মানুষীর তরে
যেই প্রেম জ্বালায়েছি পুরোহিত হ’য়ে তার বুকের উপরে!

আমি সেই পুরোহিত– সেই পুরোহিত!–
যে নক্ষত্র মরে যায়, তাহার বুকের শীত
লাগিতেছে আমার শরীরে–
যেই তারা জেগে আছে, তার দিকে ফিরে
তুমি আছো জেগে–
যে আকাশে জ্বলিতেছে, তার মতো মনের আবেগে
জেগে আছো–
জানিয়াছে তুমি এক নিশ্চয়তা — হয়েছ নিশ্চয়!
হয়ে যায় আকাশের তলে কত আলো-কত আগুনের ক্ষয়;
কতবার বর্তমান হ’য়ে গেছে ব্যথিত অতীত–
তবুও তোমার বুকে লাগে নাই শীত
যে নক্ষত্র ঝরে যায় তার!
যে পৃথিবী জেগে আছে, তার ঘাস– আকাশ তোমার!
জীবনের স্বাদ লয়ে জেগে আছ– তবুও মৃত্যুর ব্যথা দিতে
পার তুমি;
তোমার আকাশের তুমি উষ্ণ হয়ে আছ, তবু–
বাহিরের আকাশের শীতে
নক্ষত্রের হইতেছে ক্ষয়,
নক্ষত্রের মতন হৃদয়
পড়িতেছে ঝ’রে–
ক্লান্ত হয়ে– শিশিরের মতো শব্দ ক’রে!
জানো নাকো তুমি তার স্বাদ,
তোমারে নিতেছে ডেকে জীবন অবাধ,
জীবন অগাধ!
হেমন্তের ঝড়ে আমি ঝরিব যখন–
পথের পাতার মতো তুমিও তখন
আমার বুকে পরে শুয়ে রবে? — অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন
সেদিন তোমার!
তোমার আকাশ — আলো — জীবনের ধার
ক্ষয়ে যাবে সেদিন সকল?
আমার বুকের পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল
তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই! শুধু তার স্বাদ
তোমারে কি শান্তি দেবে!
আমি চ’লে যাব — তবু জীবন অগাধ
তোমারে রাখিবে ধরে সেই দিন পৃথিবীর ‘পরে;–
আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য ক’রে!

যা চেয়েছি যা পাবো না - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

যা চেয়েছি, যা পাবো না
-কী চাও আমার কাছে ?
-কিছু তো চাইনি আমি ।
-চাওনি তা ঠিক । তবু কেন
এমন ঝড়ের মতো ডাক দাও ?
-জানি না । ওদিকে দ্যাখো
রোদ্দুরে রুপোর মতো জল
তোমার চোখের মতো
দূরবর্তী নৌকো
চর্তুদিকে তোমাকেই দেখা
-সত্যি করে বলো, কবি, কী চাও আমার কাছে ?
-মনে হয় তুমি দেবী...
-আমি দেবী নই ।
-তুমি তো জানো না তুমি কে !
-কে আমি !
-তুমি সরস্বতী, শব্দটির মূল অর্থে
যদিও মানবী, তাই কাছাকাছি পাওয়া
মাঝে মাঝে নারী নামে ডাকি
-হাসি পায় শুনে । যখন যা মনে আসে
তাই বলো, ঠিক নয় ?
-অনেকটা ঠিক । যখন যা মনে আসে-
কেন মনে আসে ?
-কী চাও, বলো তো সত্যি ? কথা ঘুরিয়ো না
-আশীর্বাদ !
-আশীর্বাদ ? আমার, না সত্যি যিনি দেবী
-তুমিই তো সেই ! টেবিলের ঐ পাশে
ফিকে লাল শাড়ি
আঙ্গুলে ছোঁয়ানো থুতনি,
উঠে এসো
আশীর্বাদ দাও, মাথার ওপরে রাখো হাত
আশীর্বাদে আশীর্বাদে আমাকে পাগল করে তোলো
খিমচে ধরো চুল, আমার কপাল
নোখ দিয়ে চিরে দাও
-যথেষ্ট পাগল আছো ! আরও হতে চাও বুঝি ?
-তোমাকে দেখলেই শুধু এরকম, নয়তো কেমন
শান্তশিষ্ট
-না দেখাই ভালো তবে ! তাই নয় ?
-ভালো মন্দ জেনে শুনে যদি এ-জীবন
কাটাতুম
তবে সে-জীবন ছিল শালিকের, দোয়েলের
বনবিড়ালের কিংবা মহাত্মা গান্ধীর
ইরি ধানে, ধানের পোকার যে-জীবন
-যে জীবন মানুষের ?
-আমি কি মানুষ নাকি ? ছিলাম মানুষ বটে
তোমাকে দেখার আগে
-তুমি সোজাসুজি তাকাও চোখের দিকে
অনেকক্ষণ চেয়ে থাকো
পলক পড়ে না
কী দেখো অমন করে ?
-তোমার ভিতরে তুমি, শাড়ি-সজ্জা খুলে ফেললে
তুমি
তারা আড়ালে যে তুমি
-সে কি সত্যি আমি ? না তোমার নিজের কল্পনা
-শোন্ খুকী
-এই মাত্র দেবী বললে-
-একই কথা ! কল্পনা আধার যিনি, তিনি দেবী-
তুই সেই নীরা
তোর কাছে আশীর্বাদ চাই
-সে আর এমন কি শক্ত ? এক্ষুনি তা দিতে পারি
-তোমার অনেক আছে, কণা মাত্র দাও
-কী আছে আমার ? জানি না তো
-তুমি আছো, তুমি আছো, এর চেয়ে বড় সত্য নেই
-সিঁড়ির ওপরে সেই দেখা
তখন তো বলোনি কিছু ?
আমার নিঃসঙ্গ দিন, আমার অবেলা
আমারই নিজস্ব--শৈশবের হাওয়া শুধু জানে

-দেবে কি দুঃখের অংশভাগ ? আমি
ধনী হবো
-আমার তো দুঃখ নেই--দুঃখের চেয়েও
কোনো সুমহান আবিষ্টতা
আমাকে রয়েছে ঘিরে
তার কোনো ভাগ হয় না
আমার কী আছে আর, কী দেবো তোমাকে ?
-তুমি আছো, তুমি আছো, এর চেয়ে বড় সত্য নেই !
তুমি দেবী, ইচ্ছে হয় হাঁটু গেড়ে বসি
মাথায় তোমার করতল, আশীর্বাদ...
তবু সেখানেও শেষ নেই
কবি নয়, মুহূর্তে পুরুষ হয়ে উঠি
অস্থির দু'হাত
দশ আঙুলে আঁকড়ে ধরতে চায়
সিংহিনীর মতো ঐ যে তোমার কোমর
অবোধ শিশুর মতো মুখ ঘষে তোমার শরীরে
যেন কোনো গুপ্ত সংবাদের জন্য ছটফটানি
-পুরুষ দূরত্বে যাও, কবি কাছে এসো
তোমায় কী দিতে পারি ?
-কিছু নয় !
-অভিমান ?
-নাম দাও অভিমান !
-এটা কিন্তু বেশ ! যদি
অসুখের নাম দিই নির্বাসন
না-দেখার নাম দিই অনস্তিত্ব
দূরত্বের নাম দিই অভিমান ?
-কতটুকু দূরত্ব ? কী, মনে পড়ে ?
-কী করে ভাবলে যে ভুলবো ?
-তুমি এই যে বসে আছো, আঙুলে ছোঁয়ানো থুতনি
কপালে পড়েছে চূর্ণ চুল
পাড়ের নক্সায় ঢাকা পা
ওষ্ঠাগ্রে আসন্ন হাসি-
এই দৃশ্যে অমরত্ব
তুমি তো জানো না, নীরা,
আমার মৃত্যুর পরও এই ছবি থেকে যাবে ।
-সময় কি থেমে থাকবে ? কী চাও আমার কাছে ?
-মৃত্যু ?
-ছিঃ , বলতে নেই
-তবে স্নেহ ? আমি বড় স্নেহের কাঙাল
-পাওনি কি ?
-বুঝতে পারি না ঠিক । বয়স্ক পুরুষ যদি স্নেহ চায়
শরীরও সে চায়
তার গালে গাল চেপে দিতে পারো মধুর উত্তাপ ?
-ফের পাগলামি ?
-দেখা দাও ।
-আমিও তোমায় দেখতে চাই ।
-না !
-কেন ?
-বোলো না । কক্ষনো বোলো না আর এ কথা
আমি ভয় পাবো ।
এ শুধুই এক দিকের
আমি কে ? সামান্য, অতি নগণ্য, কেউ না
তুবি এত স্পর্ধা করে তোমার রূপের কাছে--
-তুমি কবি ?
-তা কি মনে থাকে ? বারবার ভুলে যাই
অবুঝ পুরুষ হয়ে কৃপাপ্রার্থী
-কী চাও আমার কাছে ?
-কিছু নয় । আমার দু'চোখে যদি ধুলো পড়ে
আঁচলের ভাপ দিয়ে মুছে দেবে ?

অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
চলবে না।
এবার হৃদয় মাঝে লুকিয়ে বোসো,
কেউ জানবে না, কেউ বলবে না।
বিশ্বে তোমার লুকোচুরি,
দেশ বিদেশে কতই ঘুরি -
এবার বলো আমার মনের কোণে
দেবে ধরা, ছলবে না।
আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
চলবে না।

জানি আমার কঠিন হৃদয়
চরণ রাখার যোগ্য সে নয় -
সখা, তোমার হাওয়া লাগলে হিয়ায়
তবু কি প্রাণ গলবে না।

না হয় আমার নাই সাধনা,
ঝরলে তোমার কৃপার কণা
তখন নিমেষে কি ফুটবে না ফুল
চকিতে ফল ফলবে না।
আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
চলবে না।

চিঠি দিও - মহাদেব সাহা

করুণা করে হলেও চিঠি দিও, খামে ভরে তুলে দিও
আঙ্গুলের মিহিন সেলাই

ভুল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও,
এটুকু সামান্য দাবি, চিঠি দিও, তোমার শাড়ির মতো
অক্ষরের পাড়-বোনা একখানি চিঠি।

চুলের মতন কোনো চিহ্ন দিও বিস্ময় বোঝাতে যদি চাও ...
বর্ণণা আলস্য লাগে তোমার চোখের মতো চিহ্ন কিছু দিও!

আজো তো অমল আমি চিঠি চাই, পথ চেয়ে আছি,
আসবেন অচেনা রাজার লোক
তার হাতে চিঠি দিও, বাড়ি পৌঁছে দেবে ....
এমন ব্যস্ততা যদি শুদ্ধ করে একটি শব্দই শুধু লিখো, তোমার কুশল! ...

করুণা করে হলেও চিঠি দিও, ভুলে গিয়ে ভুল করে একখানি চিঠি
দিও খামে
কিছুই লেখার নেই তবু লিখো একটি পাখির শিস
একটি ফুলের ছোট নাম,

টুকিটাকি হয়তো হারিয়ে গেছে কিছু, হয়তো পাওনি খুঁজে
সেইসব চুপচাপ কোন দুপুরবেলার গল্প
খুব মেঘ করে এলে কখনো কখনো বড় একা লাগে, তাই লিখো

করুণা করে হলেও চিঠি দিও, মিথ্যা করে হলেও বোলো, ভালবাসি !

আবৃত্তিঃ https://soundcloud.com/shamsuzzoha/chithi-dio

ওটা কিছু নয় - নির্মলেন্দু গুণ

এইবার হাত দাও, টের পাচ্ছো আমার অস্তিত্ব ? পাচ্ছো না ?
একটু দাঁড়াও আমি তৈরী হয়ে নিই ।
এইবার হাত দাও, টের পাচ্ছো আমার অস্তিত্ব ? পাচ্ছো না ?
তেমার জন্মান্ধ চোখে শুধু ভুল অন্ধকার । ওটা নয়, ওটা চুল ।
এই হলো আমার আঙ্গুল, এইবার স্পর্শ করো,–না, না, না,
-ওটা নয়, ওটা কন্ঠনালী, গরলবিশ্বাসী এক শিল্পীর
মাটির ভাস্কর্য, ওটা অগ্নি নয়, অই আমি–আমার যৌবন ।

সুখের সামান্য নিচে কেটে ফেলা যন্ত্রণার কবন্ধ–প্রেমিক,
ওখানে কী খোঁজ তুমি ? ওটা কিছু নয়, ওটা দুঃখ ;
রমণীর ভালোবাসা না-পাওয়ার চিহ্ন বুকে নিয়ে ওটা নদী,
নীল হয়ে জমে আছে ঘাসে,–এর ঠিক ডানপাশে , অইখানে
হাত দাও, হ্যাঁ, ওটা বুক, অইখানে হাত রাখো, ওটাই হৃদয় ।

অইখানে থাকে প্রেম, থাকে স্মৃতি, থাকে সুখ, প্রেমের সিম্পনি ;
অই বুকে প্রেম ছিল, স্মৃতি ছিল, সব ছিল তুমিই থাকো নি ।