Social Icons

শনিবার, ৫ এপ্রিল, ২০১৪

পরানের গহীন ভিতর - সৈয়দ শামসুল হক




জামার ভিতর থিকা যাদুমন্ত্রে বারায় ডাহুক,

চুলের ভিতর থিকা আকবর বাদশার মোহর,

মানুষ বেবাক চুপ, হাটবারে সকলে দেখুক

কেমন মোচর দিয়া টাকা নিয়া যায় বাজিকর।

চক্ষের ভিতর থিকা সোহাগের পাখিরে উড়াও,

বুকের ভিতর থিকা পিরীতের পুন্নিমার চান,

নিজেই তাজ্জব তুমি একদিকে যাইবার চাও

অথচ আরেক দিকে খুব জোরে দেয় কেউ টান।

সে তোমার পাওনার এতটুকু পরোয়া করে না,

খেলা যে দেখায় তার দ্যাখানের ইচ্ছায় দেখায়,

ডাহুক উড়াইয়া দিয়া তারপর আবার ধরে না,

সোনার মোহর তার পড়ে থাকে পথের ধুলায়।

এ বড় দারুণ বাজি, তারে কই বড় বাজিকর

যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর।।





আন্ধার তোরঙ্গে তুমি সারাদিন কর কি তালাশ?

মেঘের ভিতর তুমি দ্যাখ কোন পাখির চক্কর?

এমন সরল পথ তবু ক্যান পাথরে টক্কর?

সোনার সংসার থুয়া পাথারের পরে কর বাস?

কি কামে তোমার মন লাগে না এ বাণিজ্যের হাটে?

তোমার সাক্ষাৎ পাই যেইখানে দারুণ বিরান,

ছায়া দিয়া ঘেরা আছে পরিস্কার তোমার উঠান

অথচ বেবাক দেখি শোয়া আছে মরনের খাটে।

নিঝুম জঙ্গলে তুমি শুনছিলা ধনেশের ডাক?

হঠাৎ আছাড় দিয়া পড়ছিল রূপার বাসন?

জলপির গাছে এক কুড়ালের কোপের মতন

তাই কি তোমার দেহে ল্যাখা তিন বাইন তালাক?

এমন বৃক্ষ কি নাই, যার ডালে নাই কোন পরী?

এমন নদী কি নাই, যার বুকে নাই কোন তরী?





সে কোন বাটিতে কও দিয়াছিলা এমন চুমুক

নীল হয়া গ্যাছে ঠোঁট, হাত পাও শরীল অবশ,

অথচ চাও না তুমি এই ব্যাধি কখনো সারুক।

আমার জানতে সাধ, ছিল কোন পাতার সে রস?

সে পাতা পানের পাতা মানুষের হিয়ার আকার?

নাকি সে আমের পাতা বড় কচি ঠোঁটের মতন?

অথবা বটের পাতা অবিকল মুখের গড়ন?

তুঁতের পাতা কি তয়, বিষনিম, নাকি ধুতুরার?

কতবার গেছি আমি গেরামের শ্যাষ সীমানায়

আদাড় বাদার দিয়া অতিঘোর গহীন ভিতরে,

কত না গাছের পাতা কতবার দিয়াছি জিহ্বায়,

এমন তো পড়ে নাই পানি এই পরানে, শিকড়ে।

তয় কি অচিন বৃক্ষ তুমি সেই ভুবনে আমার,

আমারে দিয়াছো ব্যাধি, নিরাময় অসম্ভব যার?





আমি কার কাছে গিয়া জিগামু সে দুঃখ দ্যায় ক্যান,

ক্যান এত তপ্ত কথা কয়, ক্যান পাশ ফিরা শোয়,

ঘরের বিছান নিয়া ক্যান অন্য ধানখ্যাত রোয়?

অথচ বিয়ার আগে আমি তার আছিলাম ধ্যান।

আছিলাম ঘুমের ভিতরে তার য্যান জলপিপি,

বাঁশির লহরে ডোবা পরানের ঘাসের ভিতরে,

এখন শুকনা পাতা উঠানের পরে খেলা করে,

এখন সংসার ভরা ইন্দুরের বড় বড় ঢিপি।

মানুষ এমন ভাবে বদলায়া যায়, ক্যান যায়?

পুন্নিমার চান হয় অমাবস্যা কিভাবে আবার?

সাধের পিনিস ক্যান রঙচটা রদ্দুরে শুকায়?

সিন্দুরমতির মেলা হয় ক্যান বিরান পাথার?

মানুষ এমন তয়, একবার পাইবার পর

নিতান্ত মাটির মনে হয় তার সোনার মোহর।।





তোমার দ্যাশের দিকে ইস্টিশানে গেলেই তো গাড়ি

সকাল বিকাল আসে, এক দন্ড খাড়ায়া চম্পট,

কত লোক কত কামে দূরে যায়, ফিরা আসে বাড়ি-

আমার আসন নাই, যাওনেরও দারুন সংকট।

আসুম? আসার মতো আমি কোনো ঘর দেখি নাই।

যামু যে? কোথায় যামু, বদলায়া গ্যাছে যে বেবাক।

কেমন তাজ্জব সব পাল্টায়া যায় আমি তাই

দেইখাছি চিরকাল। পরানের ভিতরে সুরাখ-

সেখানে কেবল এক ফরফর শব্দ শোনা যায়,

পাখিরা উড়াল দিয়া গ্যাছে গিয়া, এখন বিরান,

এখন যতই আমি ছড়া দেই কালিজিরা ধান,

সে কি আর আঙিনায় ফিরা আসে? আর কি সে খায়?

সকাল বিকাল গাড়ি, চক্ষু আছে তাই চক্ষে পড়ে;

পলকে পলকে গাড়ি সারাদিন মনের ভিতরে।।





তোমার খামাচির দাগ এখনো কি টকটাকা লাল,

এখনো জ্বলন তার চোৎরার পাতার লাহান।

শয়তান, দ্যাখো না করছ কি তুমি কি সোন্দর গাল,

না হয় দুপুর বেলা একবার দিছিলাম টান?

না হয় উঠানে ছিল লোকজন কামের মানুষ,

চুলায় আছিল ভাত, পোলাপান পিছের বাগানে,

তোমারে পরান দিছি, তাই বইলা দেই নাই হুঁশ,

আমি তো তোমারে নিতে চাই নাই ঘরের বিছানে।

হ, জানি নিজের কাছে কোনো কথা থাকে না গোপন।

দিনের দুফুর বেলা যেই তুমি আসছিলা ঘরে

আতখা এমন মনে হইছিল- আন্ধার যেমন,

আতখা এমন ছায়া সোহাগের আর্শির ভিতরে।

আবার ডাকলে পরে কিছুতেই স্বীকার হমু না।

বুকের পাষাণ নিয়া দিমু ডুব শীতল যমুনা।।





নদীর কিনারে গিয়া দেখি নাও নিয়া গ্যাছে কেউ

অথচ এই তো বান্ধা আছিল সে বিকাল বেলায়।

আমার অস্থির করে বুঝি না কে এমন খেলায়,

আমার বেবাক নিয়া শান্তি নাই, পাচে পাছে ফেউ।

পানির ভিতরে য্যান ঘুন্নি দিয়া খিলখিল হাসে

যত চোর যুবতীরা, গ্যারামের শ্যাষ সীমানায়

বটের বৈরাগী চুল, ম্যাঘে চিল হারায় বারায়,

বুকের ভিতরে শিস দিয়া সন্ধা হাঁটে আশেপাশে।

এখন কোথায় যাই, এইখানে বড় সুনসান,

মানুষের দুঃখ আছে, জগতের আছে কিনা জানি না-

জগৎ এমনভাবে হয়া যায় হঠাৎ অচিনা।

মনে হয় আমার থিকাও একা বৃক্ষের পরান,

আমার থিকাও দুঃখী যমুনার নদীর কিনার।

আমার তো গ্যাছে এক, কত কোটি লক্ষ গ্যাছে তার।।





আমারে তলব দিও দ্যাখো যদি দুঃখের কাফন

তোমারে পিন্ধায়া কেউ অন্যখানে যাইবার চায়

মানুষ কি জানে ক্যান মোচড়ায় মানুষের মন,

অহেতুক দুঃখ দিয়া কেউ ক্যান এত সুখ পায়?

নদীরে জীবন কই, সেই নদী জল্লাদের মতো

ক্যান শস্য বাড়িঘর জননীর শিশুরে ডুবায়?

যে তারে পরান কই, সেই ব্যাক্তি পাইকের মতো

আমার উঠানে ক্যান নিলামের ঢোলে বাড়ি দ্যায়?

যে পারে উত্তর দিতে তার খোঁজে দিছি এ জীবন,

দ্যাখা তার পাই নাই, জানা নাই কি এর উত্তর।

জানে কেউ? যে তুমি আমার সুখ, তুমিই কি পারো

আমারে না দুঃখ দিয়া? একবার দেখি না কেমন?

কেমন না যায়া তুমি পারো দেখি অপরের ঘর?-

অপর সন্ধান করে চিরকাল অন্য ঘর কারো।।





একবার চাই এক চিক্কুর দিবার, দিমু তয়?

জিগাই কিসের সুখে দুঃখ নিয়া তুমি কর ঘর?

আঙিনার পাড়ে ফুলগাছ দিলে কি সোন্দর হয়,

দুঃখের কুসুম ঘিরা থাকে যার, জীয়ন্তে কবর।

পাথারে বৃক্ষের তরে ঘন ছায়া জুড়ায় পরান,

গাঙের ভিতরে মাছ সারাদিন সাঁতরায় সুখে,

বাসরের পরে ছায়া য্যান দেহে গোক্ষুর জড়ান,

উদাস সংসারে ব্যথা সারাদিন ঘাই দেয় বুকে।

তবুও সংসার নিয়া তারে নিয়া তুমি কি পাগল,

তোলো লালশাক মাঠে, ফসফস কোটো পুঁটিমাছ,

সাধের ব্যাঞ্জন করো, রান্ধো ক্ষীর পুড়ায়া আঞ্চল,

বিকাল বেলায় কর কুঙ্কুমের ফোঁটা দিয়া সাজ।

ইচ্ছা করে টান দিয়া নিয়া যাই তোমারে রান্ধুনি,

তোমার সুতায় আমি একখান নীল শাড়ি বুনি।।



১০

কে য্যান কানতে আছে- তার শব্দ পাওয়া যায় কানে,

নদীও শুকায়া যায়, আকালের বাতাস ফোঁপায়,

মানুষেরা বাড়িঘর বানায় না আর এই খানে,

গোক্ষুর লতায়া ওঠে যুবতীর চুলের খোঁপায়।

বুকের ভিতর থিকা লাফ দিয়া ওঠে যে চিক্কুর,

আমি তার সাথে দেই শিমুলের ফুলের তুলনা,

নিথর দুফুর বেলা, মরা পাখি, রবি কি নিষ্ঠুর,

আগুন লাগায়া দিবে, হবে খাক, তারি এ সূচনা।

অথচ আমারে কও একদিন এরও শ্যাষ আছে-

আষাঢ়ের পুন্নিমার আশা আর এ দ্যাশে করি না,

চক্ষু যে খাবলা দিয়া খায় সেই পাখি বসা গাছে,

অথচ খাড়ায়া থাকি, এক পাও কোথাও নড়ি না।

সকল কলস আমি কালঘাটে শূণ্য দেইখাছি,

তারে না দেইখাছি তাই দ্যাখনের চক্ষু দিতে রাজি।।



১১

কি আছে তোমার দ্যাশে? নদী আছে? আছে নাকি ঘর?

ঘরের ভিতরে আছে পরানের নিকটে যে থাকে?

উত্তর সিথানে গাছ, সেই গাছে পাখির কোটর

আছে নাকি? পাখিরা কি মানুষের গলা নিয়া ডাকে?

যখন তোমার দ্যাখা জানা নাই পাবো কি পাবো না,

যখন গাছের তলে এই দেহ দিবে কালঘুম,

যখন ফুরায়া যাবে জীবনে নীল শাড়ি বোনা,

তখন কি তারা সব কয়া দিবে আগাম-নিগুম?

আমার তো দ্যাশ নাই, নদী নাই, ঘর নাই, লোক,

আমার বিছানে নাই সোহাগের তাঁতের চাদর,

আমার বেড়ায় খালি ইন্দুরের বড় বর ফোক,

আমার বেবাক ফুল কাফনের ইরানি আতর।

তোমার কি সাধ্য আছে নিয়া যাও এইখান থিকা,

আমার জীবন নিয়া করো তুমি সাতনরী ছিকা?



১২

উঠানের সেই দিকে আন্ধারের ইয়া লম্বা লাশ,

শিমের মাচার নিচে জোছনার সাপের ছলম,

পরীরা সন্ধান করে যুবতীর ফুলের কলম,

তারার ভিতরে এক ধুনকার ধুনায় কাপাশ,

আকাশে দোলায় কার বিবাহের রুপার বাসন,

গাবের বাবরি চুল আলখেল্লা পরা বয়াতির,

গাভির ওলান দিয়া ক্ষীণ ধারে পড়তাছে ক্ষীর,

দুই গাঙ্গ এক হয়া যাইতাছে- কান্দন, হাসন।

একবার আসবা না?- তোমারেও ডাক দিতে আছে

যে তুমি দুঃখের দিকে একা একা যোজন গিয়াছো?

একবার দেখবা না তোমারেও ডাক দিতে আছে

যে তুমি আঘাত নিয়া সারাদিন কি তফাত আছো?

যে নাই সে নাই সই, তাই সই, যা আছে তা আছে,

এমন পুন্নিমা আইজ, কোন দুঃখে দুয়ার দিয়াছো?



১৩

তোমার বিয়ার দিন মনে হইল, সত্য নিও মনে,

এত বড় এত গোল কোনোদিন দেখি নাই চান।

তুলার মতন ফুল, রাণী য্যান দরবারে বসা,

নদীর গহীন তলে জোছনায় দিয়া সে প্রাসাদ।

পাথারে নিরালা গাছ আলগোছে একখানা হাত

আমার আন্ধার পিঠে দিয়া কয়, 'তোমারে সহসা

দেখাই কিভবে সব মানুষের নিজের বানান,

পরীর সাক্ষাৎ নাই গেরস্তের বাড়ির পিছনে।'

দিঘল নায়ের মতো দুঃখ এক নদী দিয়া যায়-

মাঝি নাই, ছই নাই, নাই কোনো কেরায়া কি লোক।

না হয় অনেকে কয়- এক গেলে অন্য আর আসে,

অন্যের মধ্যে কি সেই পরানের এক পাওয়া যায়?-

তাই না সচ্ছল দ্যাশ অথচ কি বিরান সড়ক।

মানুষ বোঝে না বইলা পুন্নিমার চান এত হাসে।।



১৪

কি কামে মানুষ দ্যাখে মানুষের বুকের ভিতরে

নীল এক আসমান- তার তলে যমুনার ঢল,

যখন সে দেখে তার পরানের গহীন শিকড়ে

এমন কঠিন টান আচানক পড়ে সে চঞ্চল?

কিসের সন্ধান করে মানুষের ভিতরে মানুষ?

এমন কি কথা আছে কারো কাছে না কইলে নাই?

সুখের সকল দানা কি কামে যে হইয়া যায় তুষ?

জানি নাই, বুঝি নাই, যমুনারও বুঝি তল নাই।

তয় কি বৃক্ষের কাছে যামু আমি? তাই যাই তয়?

বনের পশুর কাছে জোড়া জোড়া আছে যে গহীনে?

যা পারে জবাব দিতে, গিয়া দেখি শূণ্য তার পাড়া,

একবার নিয়া আসে আকালের কঠিন সময়,

আবার ভাসায় ঢলে খ্যাতমাঠ শুকনার দিনে,

আমার আন্ধার নিয়া দেয় না সে একটাও তারা।



১৫

আমারে সোন্দর তুমি কও নাই কোনো একদিন,

আমার হাতের পিঠা কও নাই কি রকম মিঠা,

সেই তুমি তোমারেই দিছি আমি যুবতীর চিন-

চোখ-কানা দেখ নাই বিছানায় আছে লাল-ছিটা?

তয় কি তোমারে আমি ফাঁকি দিয়া পিছন বাড়িতে

যামু তার কাছে কও আমারে যে দিতে যায় পান?

অথবা জিগার ডালে ফাঁসি নিয়া নিজের শাড়িতে

ভূত হয়া তোমার গামছায় দিমু আন্ধারে টান?

তখন আমারে তুমি দেখি হেলা করো কি রকম,

শরীল পাথর হয়া যায় কি না পানের ছোবলে,

আমারে হারায়া দেখি জমিহারা চাষী হও কি না?

এমন দেখতে বড় সাধ হয় আল্লার কসম,

দেখার বাসনা করে কালপোকা তোমার ফসলে,

অথচ ঘরেই থাকি, পোড়া ঘরে থাকতে পারি না।।



১৬

যমুনার পারে আসলে তার কথা খালি মনে হয়,

এমন পরান পড়ে- সব কিছু বিকাল-বিকাল,

লোকের চেহারা দেখি, হাত নাড়ে, নাড়ে তারা পাও,

কথা কয়, তাও বোঝা যায় না যে কি কয় কি কয়।

চক্ষের ভিতরে নাচে হাটবারে বাঁওহাতি খাল,

নায়ের উপরে দাগ- একদিন রাখছিল পাও।

জলে ভেঁজা, কত বর্ষা গ্রীষ্মকাল গ্যাছে তারপর,

কতবার নাও নিয়া পাড়ি দিছি এ কুল ও কুল,

তাও সেই পাড় আমি চিনি নাই, দেখি নাই গাঙ্গে।

বুকের ভিতরে ঢেলা সারাদিন কিষানেরা ভাঙ্গে,

রাখাল নষ্টামি করে, পড়ে লাল শিমুলের ফুল,

জলের ভিতরে নড়ে মনে বান্ধা আছিল যে ঘরে।

কইছিল সে আমারে- সেই পাড়ে নিবা না আমারে?

কোন পাড়? ইচ্ছা তার আছিল সে যায় কোন পাড়ে?



১৭

এমন অদ্ভুতভাবে কথা কয়া ওঠে কে, আন্ধারে?-

য্যান এক উত্তরের ধলাহাঁস দক্ষিণের টানে

যাইতে যাইতে শ্যাষে শুকনা এক নদীর কিনারে

ডাক দিয়া ওঠে, ‘আগো, চেনা কেউ আছো কোনোখানে?’

আমি তো নিরালা মনে আছিলাম আমার সংসারে,

তার সেই ডাক, সেই কান্দনের আওয়াজটা কানে

যাইতেই দেখি য্যান একা আমি চৈতের পাথারে-

আমারে আমার সব নিদারুণ তীর হয়া হানে।

আমি তা্রে কি দিব উত্তর? তারে কোন কথা কই?

সে ক্যান আমারে ডাক দিয়া গেল, বুঝিনা ইয়াও।

আমি কি করবার পারি? কতটুকু ক্ষমতা আমার?

উপস্থিত মনে হয়, তারে আমি ডাক দিয়া লই,

ঝাপাইয়া ছিনতাই করি যমুনার ছিপছিপা নাও,

সকল ফালায়া দিয়া নিরুদ্দেশ সাথে যাই তার।।



১৮

এ কেমন শব্দ, এ কেমন কথার আদব?

কাতারে কাতার খাড়া, আমি তার ভেদ বুঝি নাই।

নিজের চিন্তার পাখি উড়ায়া যে দিমু কি তাজ্জব,

খানিক হুকুম মানে, তারপর বেবাক নাজাই।

শব্দের ভিতর থিকা মনে হয় শুনি কার স্বর,

একজন, দুইজন, দশজন, হাজার হাজার-

আমার মতন যারা ছিল এই মাটির উপর,

এখন কবরে গ্যাছে, করি আমি তাদেরই বাজার।

এরেই বন্ধন কয়? এর থিকা মুক্তি কারো নাই।

যখনি তোমার ভাষা আমি কই, তুমি ওঠো কয়া,

আমার মূর্তির মুখ আলগোছে বদলায়া দ্যাও।

যদিবা চেতনা পায়া কিছু করি হাতে লাগে ছ্যাও।

আসলে তোমার মতো এতখানি কেউ না নিদয়া,

যার দ্যাশ তার দ্যাশে চলে তার নিজের টাকাই।।



১৯

পথের উপরে এক বাজপড়া তালগাছ খাড়া,

পিছের জঙ্গল থিকা কুড়ালের শব্দ শোনা যায়,

যমুনার জলে দ্যাখে নাও তার নিজের চেহারা,

বাতাসের কোলে মাথা কুশালের ফসল ঘুমায়,

ধুলায় চক্কর দিয়া খেলা করে বিরান পাথার,

তুলার অনেকগুলা ফুল আটকা জিগার আঠায়,

দমের ভিতরে থামা বুকরঙ্গি মাছের কাতার,

আতখা বেবাক য্যান গিয়া পড়ছে অচিনঘাটায়।

আমিও সেবার এক সুনসানে গিয়া পড়ছিলাম-

য্যান সব টান দিয়া নিয়া গ্যাছে সে কার বারুন,

যেইদিকে চাই দেখি ভয়ানক নিঝুম নিথর,

নিয়া গ্যাছে নাম ধাম আর ইচ্ছার নায়ের বাদাম,

অঙ্গের কুসুম নিয়া খেলা করছে দুফর দারুণ,

যেদিন ফালায়া গেল আমারে সে আমার ভিতর।।



২০

কি কামে দুফর বেলা পাতাগুলা উড়ায় বাতাস?

আবার সে কার স্বর মাঠাপাড়ে ফোঁপায় এমন?

কি কামে আমার চক্ষে পড়ে খালি মানুষের লাশ?

যা দ্যাখার দেইখাছি, বাকি আছে আর কি দ্যাখন?

সময় দেখায়া গ্যাছে বাল্যকালে আমের সুঘ্রাণে?

যৈবন অন্যের হাতে য্যান এক কাচের বাসন,

দুঃখের পাখিরে আমি দেইখাছি বিয়ার বিহানে,

কিভাবে কালির লেখা হয়া যায় জলের লিখন।

আমারে ছাড়ান দিয়া যায় না সে যেখানেই যাই,

দ্যাশ কি বিদ্যাশ কও, চিনা কিংবা অচিনাই হও,

দুঃখের বাদাম তোলা সেই এক নাও সব গাঙ্গে।

পালায়া নিস্তার কই? সবখানে সেই না শানাই।

যেইখানেই যাই গিয়া, খাড়া দেখি সেই শও শও

পুয়ারন মিস্তিরি- তারা মনোযোগ দিয়া সব ভাঙ্গে।।



২১

হাজার দক্ষিণ দিকে যাও তুমি গাঙ্গের মোহানা

পাও যদি কইও আমারে। আমি না অনেক দিন

আমার যৈবন আমি মোহানার খোঁজে না দিলাম,

তাও তারে দেখি নাই, শুনি আছে ধলা গাঙচিল,

মাছের পাহারা ঘেরা খিজিরের অতল আস্তানা,

আছে তার ইশারায় আগুনের দেহ এক জ্বীন-

যদি ইচ্ছা করে তার অসম্ভব নাই কোন কাম,

যারে না পাইতে পারি তারো সাথে দিতে পারে মিল।

তুমি যে মনের মতো ঘরে আছো এই কথা কও-

সেই ভাগ্য মনে হয় খিজিরের বিশেষ অছিলা।

আমার হিসাবে কয়- মানুষের সাধ্য নাই পায়।

যতই সাধনা কর, পরানের যত কাছে রও

সে জন দুরেই থাকে, তুমি থাকো যেখানে আছিলা।

আমার জানতে সাধ, মোহানায় গ্যাছে কোন নায়।।



২২

এক্কেরে আওয়াজ নাই, নদী খালি চাপড় দিতাছে

গেরামের পিঠে আর ফিসফাস কইতাছে, ‘ঘুম,

ঘুমারে এখনতরি সাতভাই পূর্বদিকে আছে।‘

এক ফোঁটা ঘুম যে আসে না তার আমি কি করুম?

অখনো খেজুরগাছে টুপটুপ রস পড়তে আছে,

এত যে কান্দন আছে- তয় চক্ষু ভেজে না কেমন?

ঘাটের যুগল নাও য্যান ঠোঁটে ঠোঁট দিয়া আছে,

আমার দক্ষিণ পাশে সরে নাই চান্দের গেরন।

আধান শীতলপাটি ভরা এক আমাবস্যা নিয়া

দেখি রোজ উত্তরের একদল ধলাহাঁস নামে,

বুকের ভিতরে চুপ, তারপর আতখা উড়াল-

এ দ্যাশে মানুষ নাই, অন্যখানে তাই যায় গিয়া।

এখানে কিসের বাড়ি? এত দ্রব্য আসে কোন কামে?

কেউ না দেখুক, তারা দেইখাছে দুঃখের কুড়াল।।



২৩

আমারে যেদিন তুমি ডাক দিলা তোমার ভাষায়

মনে হইল এ কোন পাখির দ্যাশে গিয়া পড়লাম,

এ কোন নদীর বুকে এতগুলা নায়ের বাদাম,

এত যে অচিন বৃক্ষ এতদিন আছিল কোথায়?

আমার সর্বাঙ্গে দেখি পাখিদের রাতির পালক,

নায়ের ভিতর থিকা ডাক দ্যায় আমারে ভুবন,

আমার শরীলে য্যান শুরু হয় বৃক্ষের রোপণ,

আসলে ভাষাই হইল একমাত্র ভাবের পালক।

তাই আমি অন্যখানে বহুদিন ছিলাম যদিও,

যেদিন আমারে তুমি ডাক দিলা নিরালা দুফর,

চক্ষের পলকে গেল পালটায়া পুরানা সে ঘর,

তার সাথে এতকাল আছিল যে ভাবের সাথীও।

এখন আমার ঠোঁটে শুনি আমি অন্য এক স্বর,

ভাষাই আপন করে আর সেই ভাষা করে পর।।



২৪

আবার তোমার কোলে ফিরা যায় তোমার সন্তান,

আবার তোমার কোলে, খালি কোল, উথলায়া পড়ে

দুধের ঘেরানে ভরা, জননী গো, পুন্নিমার চান-

আবার সে ঘরে ফিরা আইসাছে সারাদিন পরে।

আবার সে আইসাছে করালের ঘুম চক্ষে নিয়া,

চক্ষের ভিতরে তার গেরেপ্তার বিহানের সোনা,

তবনের নীল খোপে শিমুলের লাল রঙ নিয়া,

আবার সে আইসাছে, জননী গো, তুমি কাইন্দো না।

তোমার সন্তান গ্যাছে জননী গো, সে আমার না ভাই,

আমার দেহের থিকা একখানা কাটা গ্যাছে হাত,

উঠানে খাড়ায়া আছি, খুলবা না তোমার দুয়ার?

আমার মতন যারা হারায়াছে আইজ তার ভাই,

য্যান শিলাবিষ্টি শ্যাষে পরিস্কার আকাশ হঠাৎ ,

হাজার হাজার তারা ঘিরা আছে পুন্নিমা তোমার।।



২৫

কত না দুধের ক্ষীর খায়া গ্যাছে কালের গোপাল,

কতবার কত রোয়া কারবালা খ্যাতের খরায়,

কন না রঙিলা নাও নিয়া গ্যাছে কাল যমুনায়,

অঘোরে হারায়া গাভি ফেরে নাই নিজস্ব রাখাল।

কত না পুকুর দিতে পারে নাই পানি গ্রীষ্মকালে,

বাসকের ছাল কত ভালো করতে পারে নাই রোগ,

দেহের কত না রক্ত খায়া গ্যাছে কত ছিনাজোঁক,

কুসুম উধাও হয়া গ্যাছে কত শিমুলের ডালে।

তাই কি ছাড়ান দিমু বিহানের ধবল দোহান?

কামারের কাছে বান্ধা দিমু এই রূপার লাঙ্গল?

আমার বৃক্ষেরে তাই দিতে কমু জহরের ফল?

বাদ দিয়া দিমু কও পরানের গহীন কথন?

আমার তিস্তারে দেখি, সেও পোষ মানে না ভাটিতে,

কি তার উথাল নাচ গেরস্তের সমান মাটিতে!



২৬

ক্যান তুই গিয়াছিলি?- আমি তরে জিগামু অখন

চান্দের ভিতর ফের, যেইখানে জটিলতা বাড়ে,

অশথ জড়ায়া থাকে নদী নিয়া জলের কিনারে,

আমার গেরাম ঘিরা যেইখানে খালি পলায়ন-

মানুষের, মানুষের, আর তর চক্ষের কাজল,

যেইখানে মেলা দেয় একখান সুনসান নাও,

যে নায়ে সোয়ার নাই, ‘কেডা যাও, কেডা বায়া যাও?’

বেকল আছাড় দিয়া ওঠে কালা যমুনার জল?

কেউ নাই, কেউ তর নাই, তুই নিজেই জানস,

তবু ক্যান গিয়াছিলি? ক্যান তুই দিয়াছিলি ফাল?

কিসের কি বাদ্যে তর রক্ত করে উথাল পাথাল

আমারে ক’ দেখি তুই? ক’না দেখি, কি চিল মানস?

ল’যাই জলের ধারে দ্যাখ ছায়া আমার কি তর?

মানুষে মানুষে নাই কোনো ভেদ দুঃখের ভিতর।।



২৭

আউসের খ্যাতে মাঠে যুবতীরা দিতাছে সাঁতার,

দ্যাখো না কেমন তারা চিতলের মতো খেলা করে,

কি তারা তালাশ করে দিনমান নাগর ভাতার-

যারা ডুব দিয়া আছে এই ধান বানের সাগরে;

বিছনের মতো পড়ে তারাবাজি চুমার চুমার,

কি ঘাই আতখা মারে খলবল এই হাসে তারা

একজন দুইজন সাতজন নাকি বেশুমার

বুকের ভিতরে ভাঙ্গে নিশীথের শরমের পাড়া।

আমি যেই সেইখানে আচানক গিয়া পড়লাম

চক্ষের নিমেষে তারা নাই আর কোনোখানে নাই,

আমি যেই সেইখানে তোমারেনি খোঁজ করলাম-

কিছু না দেইখা নিজে বেয়াকুফ বড় শরমাই।

এই ছিল এই নাই, কই গেল, কই যার তারা?

বেমালুম কই তুমি যাও গিয়া খা’বের ইশারা?



২৮

ঝকঝক ঝকঝক সারাদিন করে আয়নাটা-

বুকে নাই ছবি নাই পড়ে নাই একখানা ছবি,

বেবাক একাকী য্যান সুনসান ইস্কুরুপে আঁটা,

যা চাই তা নাই তয় চমৎকার আছে আর সবি।

আছে সবি আছে এক মইষের শিঙ্গের চিরুনি,

রুমাল, চুলের ফিতা জবজবা এখনোনি ত্যালে।

বিবাহের বাসরে শ্যাষ য্যান গেছে সে ফিরুনি-

ফেরার আশাও নাই, ফেরা নাই একবার গ্যালে।

গেছে তো আমারে যদি বেরহম নিয়া যায় সাথে,

আমি তো এমন ঘরে বাস করি আশা করি নাই;

য্যান হাত দিয়া আছি ইন্দুরের বিষআলা ভাতে,

তবু তো ধরে না বিষ মুখে তুলি যত লোকমাই।

নিজেরও পড়ে না ছবিকাটা সেই আয়নায়,

সে নাই চেহারা নাই, খালি বড় খালি তড়পায়।।



২৯

তোমারে যে ভালোবাসে এর থিকা আরো পাঁচগুন

আল্লার কসম আমি দিমু তারে এই জামাখান,

আমার কলম আমি দিমু তারে, শরীলের খুন

দোয়াত ভরায়া দিমু, অনুরোধ খালি একখান-

সে য্যান আমার থিকা আরো ভালো পদ্য লেখে আর

যাদুমন্ত্রে রূপার শিকল হাতে দিতে পারে তার।

তোমারে যে ভালোবাসে এর থিকা আরো দশগুন

আল্লার কসম আমি দিমু তারে এই বাড়িখান,

আমার উঠান আমি দিমু তারে, শীতের আগুন-

নিজেই সাজায়া দিমু, অনুরোধ খালি একখান-

সে য্যান আমার থিকা আরো ভালো নিদ্রা যায় আর

তারেই নিকটে পায় কথা যার নিকটে থাকার।

নচেৎ নষ্টামি জানি, যদি পাছ না ছাড়ে আমার,

গাঙ্গেতে চুবান দিয়া তারে আমি শুকাবো আবার।।



৩০

আরে ও ইসের বেটি, চুলে দিয়া শিমুলের ফুল

যাস কই, কই যাস? যুবকের মাঝখান দিয়া?

মানুষ গাঙ্গের মতো, বানে ভাসে তারো দুই কুল-

সে পানি কাতান বড়, খলবল রঙ তার সিয়া।

আরে থাম, কই যাস? তবু যায় ঘুরনান দিয়া?

শিমুল যতই লাল সেই লাল তবু কিছু কম

যত লাল যেইখানে দেহ তর লুকায় শরম।

খাড়া না করুক দেখি একবার কেউ তরে বিয়া।

বেবাক পানির টান সেইকালে নরোম সোঁতায়,

তখন পরীর রানী সেও কিনা অতি বাধ্য বশ,

তখন দেখিনা তুই আইলের বেড়া নি ভাঙ্গস,

তখন শরম দেখি থাকে তর কেমন কোথায়?

নষ্ট তর পায়ে পায়ে স্বন্নলতা আনন্তের মূল,

দিবিনে তখন তুই সিঙ্গারের আসল মাশুল।।



৩১

কে করে পরশ তার জীবনের এত জটিলতা?

তোমার অধিক টান দেয় বৃক্ষ দেয় বিষলতা;

একবার আমারে আছাড় দিয়া সোজা করে ফের,

আমারই মতন যারা বেশুমার সন্তান মায়ের।

কিসে যে চালনা করে এই দেহ এই ভবিষ্যৎ-

কিছুই বুঝি না, দেখি আচানক শেষ হয় পথ;

যে পথেই মেলা দেই সেই পথে ভয়ানক ভুত-

এ বড় কঠিন জাগা, বসবাস বড়ই অদ্ভুত।

তয় কি ছাড়ান দিমু হাতে ধরা শেষ রশিখান?

তয় কি পাথারে দিমু হাতে ধরা বেঘোরে পরান?

নাকি তুমি একবার হাত দিয়া ডাক দিবা কাছে

আমারেও আমার মতন যারা একা একা আছে,

সকলেরে একজোট কইরা নি তুলবা আবার?

তোমার নিকটে রাখি নিদানের এই দরবার।।



৩২

নিঝুম জঙ্গল দিয়া যাইতেই ধনেশের ডাক।

যেমন আতখা ভাঙ্গে কাঠুরার বুকের কাছাড়

চক্ষের পলকে তুমি দেখা দিয়া করো মেছমার;

রতির আগুনে সব দাউদাউ, পরিণামে খাক

আমার এ দেহ বটে, ভবিষ্যৎ পায় না নিস্তার;

সকল কিছুর পরে দ্যাও তুমি উড়ায়া বাদাম,

তীরের মতন তারা ধায়া যায় কও কোন ধাম?

বরং তোমার থিকা দয়াবতী জোয়ার নিস্তার।

তবুও আবার আমি ধনেশের মতো দিয়া ডাক

আবার পাথার বন পথ ঘাট বাজার সংসার

তালাশ করুম আর গাভীনের করুম সন্ধান,

আবার দেখুম আমি ছাই-পোকা মাজরার ঝাঁক

কিভাবে আমার খ্যাত করে সব শস্য ছারখার,

আবারো বুনুম আমি এই খ্যাতে কাউনের ধান।।



৩৩

এমন বৃক্ষ কি নাই ডালে যার নাই কোন পরী,

এমন নদী কি নাই জলে যার পড়ে না চেহারা,

এমন যাত্রা কি নাই যাতে নাই পবনের তরী,

এমন ডুলি কি নাই যাতে নাই নিষেধের ঘেরা,

এমন নারী কি নাই বুকে যার নাই ভালোবাসা,

এমন পত্র কি নাই বাক্যে যার নাই নিরাময়,

এমন শস্য কি নাই যার বীজ বোনে নাই চাষা,

এমন মৃত্যু কি নাই যাতে নাই খোয়াবের লয়?

এমন কি রূপ আছে রূপ যার গড়ে না কুমার,

এমন কি দেখা আছে দেখা যার চোখে না কুলায়,

এমন কি কথা আছে কথা যার থাকে না ধুলায়,

এমন কি নেশা আছে নেশা যার অধিক চুমার?

পরানে পরান যদি এই মতো হাজার সোয়াল

সারাদিন যমুনায় খলবল বিতল বোয়াল।।

হাত বাড়ালে বল্‌বি হেসে আমি তো তোর নই - সৈয়দ নূর কামাল

চল্‌না আবার দু’জন মিলে আগের মতো হই
হৃদয় ভরা দুঃখ সুখের গল্প কথা ক’ই

বাড়ির পাশের কুলের বনে, বসে দু’জন নিরজনে
গোপন যতো মনের কথা চোখের ভাষায় ক’ই

জড়িয়ে ধরে বুকের ভেতর, করতে যখন চাইব আদর
বলিস রেগে আমি যেনো সীমার মাঝে রই

ভ্রমর কালো দীঘল চুলে, বাঁধ্‌বি বেণি শিউলি ফুলে
হাত বাড়ালে বল্‌বি হেসে আমি তো তোর নই

টস্‌টসে লাল অধর পরে, চুম্‌তে গেলে জড়িয়ে ধরে
বল্‌বি ফুঁসে এই ফাজিলের কেম্‌নে জ্বালা স’ই

থাকলে দু’দিন কোনখানে, ঠোঁট ফোলাবি অভিমানে
কইলে কিছু বল্‌বি রেগে "আমি কে তোর হই

চল্‌না আবার দু’জন মিলে আগের মতো হই
হৃদয় ভরা দুঃখ সুখের গল্প কথা কই

কী করলি? - শর্মিষ্ঠা ঘোষ

ঐ ছেলে, তুই করলি টা কী?
মরা ডালে হাত ছোঁয়ালি?
এখন আমার কাঁপছে মাটি শেকড় তলে
কাঁপছে আমার ভূবন জুড়ে মরণ বাঁচন ছন্দ সকল
তিরতিরানি চরা স্রোতের ঝরনা নামে বুকের তলে।

ঐ ছেলে, তোর ধরণ কেমন?
তরুণ যুবক ঝরের মাতন
ঝরা পাতার তরাস জাগাস
আমার এমন সাঁঝ বেলাতে?
সমুদ্দুরের ডাক পাঠালি,
ভাঁটির গাঙে উজান এল
মরা নদীর কুল ছাপিয়ে ভাসিয়ে দিলই মিথ্যে বাঁচন
চোখে কি তোর ঘোর লেগেছে?
চুলের ঢলে বাড়ছে বয়েস
ত্বকের সকল বলিরেখা অভিজ্ঞতার গল্প বলে
রক্তে শুনি শীতল শীতল সরীসৃপের শিরশিরানি
দৃষ্টি মেলি এখন আমি হিমবাহের ওপার থেকে
শেষ বেলাতে হৃদয় হরণ কেন আকুল উল্টো টানিস?
উঠলো তলে স্থিতধী মন,
পায়ের মাটি অনিশ্চিত।

তুহু মম শ্যামসমান - রেজা রহমান

এক

আসেনা আসেনা ঘুম
যদি বা আসেই সে ভেঙে যায়
কে তাকে রোখে কে ফেরায়!
ভেঙে যাবে কাঁচ তো নয় ঝনঝন
না কেউ শোনে বা না দেখে ভাঙন।

ছবি নেই দেখি
গান নেই শুনি
পল গুনি কি মুহূর্ত গুনি
জানিনে জানিনে সে তো নিজে
যত বুজতে চাই চোখ
তত আসে ভিজে।

কাউকে কি ছোঁবে এই ছবি
দু’পঙক্তি কি লিখবে কোন কবি
কেউ কি গাইবে একটা গান
মরণ রে তুহু মম শ্যামসমান?
কথা ছিল বলা যায়
শুনবেটা কে!
এ-ঘরে সবাক প্রাণী একটাই থাকে।
বাকি যারা আরশোলা ইঁদুর

হরপ্পা মহেঞ্জোদারো থেকে আর দূর
কোথাও কি জেগে আছে আর কেউ
এই আমার মত
কাঁটা ছেঁড়া পোড়া খুব ক্ষত বিক্ষত
নিতে পারে যে আমার কল
যুক্ত হয়ে গড়া যায়
মুক্তশক্তি ঐক্য অবিচল?

গড়ে কি তোলা যায় সিদ্ধবাক
অলৌকিক খেয়া
কুহকিনী নিশীথিনী উত্তাল
সমুদ্র পাড়ি দেয়া
রাতভোরে আলোকণা চিকচিক
বালুকাবেলায়
যেখানে আঁধার মেলে চোখ
বুজে আলোর মেলায়?
সারাদিনমান
দুইভাগ জল আর একভাগ
ডাঙায় শয়ান
শান্তিঘুম নেমে আসে নীলাকাশ থেকে
পরাপাখি তুইও ঘুমো প্রাণ।

এক শিশি চোখের জল এবং ... - আনিসুল হক

আমি প্রতিমাসে এক শিশি চোখের জল কিনি
এর নাম রিফ্রেশ টিয়ার
মেডইন টেক্সাস ইউএসএ

আমার ডাক্তার এই ড্রপারটা সর্বদা পকেটে রাখতে বলেছেন
যখনই আমার কাঁদতে ইচ্ছা করে
আমি যেন সেটা ইউজ করতে পারি

সেদিন ওষুধের দোকানে গিয়ে
আমি এক শিশি রিফ্রেশ লাফটার চাইলাম

এই ওষুধের দোকানি আমার সব খবর রাখেন

আমার হার্টের খবর
আমার ব্লাড প্রেসারের খবর
এমনকি মাসে আমার কতগুলো নিরোধক লাগে
আমি চোখের জল কিনি তিনি জানেন
আমি মুখের হাসি কিনতে চাই শুনে তিনি হাসলেন

আমি তার মুখের হাসিটা কিনতে পারলাম না
ওটা বাজারজাত করার কথা যখন ভাবছি

তখনই দেখি ওটা পেটেন্ট করা হয়ে গেছে ...

জলহাওয়ার লেখা - জয় গোস্বামী

স্নেহসবুজ দিন
তোমার কাছে ঋণ

বৃষ্টিভেজা ভোর
মুখ দেখেছি তোর

মুখের পাশে আলো
ও মেয়ে তুই ভালো

আলোর পাশে আকাশ
আমার দিকে তাকা–

তাকাই যদি চোখ
একটি দীঘি হোক

যে-দীঘি জ্যো‌ৎস্নায়
হরিণ হয়ে যায়

হরিণদের কথা
জানুক নীরবতা–

নীরব কোথায় থাকে
জলের বাঁকে বাঁকে

জলের দোষ? — নাতো!
হাওয়ায় হাত পাতো!

হাওয়ার খেলা? সেকি!
মাটির থেকে দেখি!

মাটিরই গুণ? — হবে!
কাছে আসুক তবে!

কাছে কোথায়? — দূর!
নদী সমুদ্দুর

সমুদ্র তো নোনা
ছুঁয়েও দেখবো না

ছুঁতে পারিস নদী–
শুকিয়ে যায় যদি?

শুকিয়ে গেলে বালি
বালিতে জল ঢালি

সেই জলের ধারা
ভাসিয়ে নেবে পাড়া

পাড়ার পরে গ্রাম
বেড়াতে গেছিলাম

গ্রামের কাছে কাছে
নদীই শুইয়ে আছে

নদীর নিচে সোনা
ঝিকোয় বালুকণা

সোনা খুঁজতে এসে
ডুবে মরবি শেষে

বেশ, ডুবিয়ে দিক
ভেসে উঠবো ঠিক

ভেসে কোথায় যাবো?
নতুন ডানা পাবো

নামটি দেবো তার
সোনার ধান, আর

বলবোঃ শোন, এই
কষ্ট দিতে নেই

আছে নতুন হাওয়া
তোমার কাছে যাওয়া

আরো সহজ হবে
কত সহজ হবে

ভালোবাসবে তবে? বলো
কবে ভালোবাসবে?

আসমানী প্রেম - নির্মলেন্দু গুণ

নেই তবু যা আছের মতো দেখায়
আমরা তাকে আকাশ বলে ডাকি,
সেই আকাশে যাহারা নাম লেখায়
তাদের ভাগ্যে অনিবার্য ফাঁকি !

জেনেও ভালোবেসেছিলাম তারে ,
ধৈর্য ধরে বিরহ ভার স'বো ;
দিনের আলোয় দেখাবো নিষ্প্রভ
জ্বলবো বলে রাতের অন্ধকারে ।

আমায় তুমি যতোই ঠেলো দূরে
মহাকাশের নিয়ম কোথায় যাবে ?
আমি ফিরে আসবো ঘুরে ঘুরে
গ্রহ হলে উপগ্রহে পাবে !

মাটি হলে পাবে শস্য- বীজে
বাতাস হলে পাবে আমায় ঝড়ে !
মৃত্যু হলে বুঝবে আমি কি যে ,
ছিলেম তোমার সারাজীবন ধরে !

কথোপকথন -৪ - পুর্ণেন্দু পত্রী

- যে কোন একটা ফুলের নাম বল।
- দুঃখ ।
- যে কোন একটা নদীর নাম বল।
- বেদনা ।
- যে কোন একটা গাছের নাম বল।
- দীর্ঘশ্বাস ।
- যে কোন একটা নক্ষত্রের নাম বল।
- অশ্রু ।
- এবার আমি তোমার ভবিষ্যত বলে দিতে পারি ।
- বলো ।
- খুব সুখী হবে জীবনে ।
শ্বেত পাথরে পা ।
সোনার পালঙ্কে গা ।
এগুতে সাতমহল
পিছোতে সাতমহল ।
ঝর্ণার জলে স্নান
ফোয়ারার জলে কুলকুচি ।
তুমি বলবে, সাজবো ।
বাগানে মালিণীরা গাঁথবে মালা
ঘরে দাসিরা বাটবে চন্দন ।
তুমি বলবে, ঘুমবো ।
অমনি গাছে গাছে পাখোয়াজ তানপুরা,
অমনি জোৎস্নার ভিতরে এক লক্ষ নর্তকী ।
সুখের নাগর দোলায় এইভাবে অনেকদিন ।
তারপর
বুকের ডান পাঁজরে গর্ত খুঁড়ে খুঁড়ে
রক্তের রাঙ্গা মাটির পথে সুড়ঙ্গ কেটে কেটে
একটা সাপ
পায়ে বালুচরীর নকশা
নদীর বুকে ঝুঁকে-পড়া লাল গোধূলি তার চোখ
বিয়েবাড়ির ব্যাকুল নহবত তার হাসি,
দাঁতে মুক্তোর দানার মত বিষ,
পাকে পাকে জড়িয়ে ধরবে তোমাকে
যেন বটের শিকড়
মাটিকে ভেদ করে যার আলিঙ্গন ।
ধীরে ধীরে তোমার সমস্ত হাসির রঙ হলুদ
ধীরে ধীরে তোমার সমস্ত গয়নায় শ্যাওলা
ধীরে ধীরে তোমার মখমল বিছানা
ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে, ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে সাদা ।
- সেই সাপটা বুঝি তুমি ?
- না ।
- তবে ?
- স্মৃতি ।
বাসর ঘরে ঢুকার সময় যাকে ফেলে এসেছিলে
পোড়া ধুপের পাশে ।

বুধবার, ২ এপ্রিল, ২০১৪

মনে থাকবে? - আরণ্যক বসু

পরের জন্মে বয়স যখন ষোলোই সঠিক
আমরা তখন প্রেমে পড়বো
মনে থাকবে?
বুকের মধ্যে মস্ত বড় ছাদ থাকবে
শীতলপাটি বিছিয়ে দেব;
সন্ধে হলে বসবো দু'জন।
একটা দুটো খসবে তারা
হঠাৎ তোমার চোখের পাতায় তারার চোখের জল গড়াবে,
কান্ত কবির গান গাইবে
তখন আমি চুপটি ক'রে দু'চোখ ভ'রে থাকবো চেয়ে...
মনে থাকবে?
এই জন্মের দূরত্বটা পরের জন্মে চুকিয়ে দেব
এই জন্মের চুলের গন্ধ পরের জন্মে থাকে যেন
এই জন্মের মাতাল চাওয়া পরের জন্মে থাকে যেন
মনে থাকবে?
আমি হবো উড়নচন্ডি
এবং খানিক উস্কোখুস্কো
এই জন্মের পারিপাট্য সবার আগে ঘুচিয়ে দেব
তুমি কাঁদলে গভীর সুখে
এক নিমেষে সবটুকু জল শুষে নেব
মনে থাকবে?
পরের জন্মে কবি হবো
তোমায় নিয়ে হাজারখানেক গান বাঁধবো।
তোমার অমন ওষ্ঠ নিয়ে,
নাকছাবি আর নূপুর নিয়ে
গান বানিয়ে__
মেলায় মেলায় বাউল হয়ে ঘুরে বেড়াবো...
মনে থাকবে?
আর যা কিছু হই বা না হই
পরের জন্মে তিতাস হবো
দোল মঞ্চের আবীর হবো
শিউলিতলার দুর্বো হবো
শরৎকালের আকাশ দেখার__
অনন্তনীল সকাল হবো;
এসব কিছু হই বা না হই
তোমার প্রথম পুরুষ হবো
মনে থাকবে?
পরের জন্মে তুমিও হবে
নীল পাহাড়ের পাগলা-ঝোরা
গায়ের পোষাক ছুড়ে ফেলে
তৃপ্ত আমার অবগাহন।
সারা শরীর ভ'রে তোমার হীরকচূর্ণ ভালোবাসা।
তোমার জলধারা আমার অহংকারকে ছিনিয়ে নিল।
আমার অনেক কথা ছিল
এ জন্মে তা যায়না বলা
বুকে অনেক শব্দ ছিল__
সাজিয়ে গুছিয়ে তবুও ঠিক
কাব্য করে বলা গেল না!
এ জন্ম তো কেটেই গেল অসম্ভবের অসঙ্গতে
পরের জন্মে মানুষ হবো
তোমার ভালোবাসা পেলে
মানুষ হবোই মিলিয়ে নিও!