Social Icons

রবিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৪

যদি‬ - মহাদেব সাহা

তোমার গোপন ভালোবাসা মিথ্যে হতো যদি
মরুর বুকে বইতে কি অন্তঃশীলা নদী ?

আমার জন্য না থাকলে
তোমার স্নেহধারা,
এই আকাশে ফুটতো
একটিও তারা ;

তোমার বুকে না থাকলে একটুখানি ছায়া
থাকতো কি কোথাও আর
এই স্নেহমায়া !

আমার জন্য ভালোবাসা
না থাকতো যদি
শুকিয়ে যেতো পৃথিবীর গভীরতম নদী ।

‪তবু কেন‬ - মহাদেব সাহা

চোখে তোমার চাঁদের সরোবর
আকাশ এসে বেঁধেছে তার ঘর,
মেঘের সাথে মিলেছে বুঝি নদী
বিদায় জানায় শস্য নিরবধি ।

আমার চোখে তপ্ত মরুভূমি
তবু এসে দাঁড়াও যদি তুমি,
হঠাৎ যেন কেমন করে হয়
মরুর বুকে শান্ত জলাশয় ।

সত্যি তখন গুলিয়ে ফেলি সব
দুঃসময়ে করি এ উৎসব,
তোমার চোখে চাঁদের সরোবর
তবু কেন আধাঁর আমার ঘর !

তুমি চলে যাবে বলতেই - মহাদেব সাহা

তুমি চলে যাবে বলতেই বুকের মধ্যে
পাড় ভাঙার শব্দ শুনি-
উঠে দাঁড়াতেই দুপুরের খুব গরম হাওয়া বয়,
মার্সির কাঁচ ভাঙতে শুরু করে;
দরোজা থেকে যখন এক পা বাড়াও আমি
দুই চোখে কিছুই দেখি না-
এর নাম তোমার বিদায়, আচ্ছা আসি, শুভরাত্রি,
খোদা হাফেজ।
তোমাকে আরেকটু বসতে বললেই তুমি যখন
মাথা নেড়ে না, না বলো
সঙ্গে সঙ্গে সব মাধবীলতার ঝোপ ভেঙে পড়ে;
তুমি চলে যাওয়ার জন্যে যখন সিঁড়ি দিয়ে নামতে থাকো
তৎক্ষণাৎ পৃথিবীর আরো কিছু বনাঞ্চল উজাড়
হয়ে যায়,
তুমি উঠোন পেরুলে আমি কেবল শূন্যতা শূন্যতা
ছাড়া আর কিছুই দেখি না
আমার প্রিয় গ্রন্থগুলির সব পৃষ্ঠা কালো কালিতে ঢেকে যায়।
অথচ চোখের আড়াল অর্থ কতোটুকু যাওয়া,
কতোদূর যাওয়া- হয়তো নীলক্ষেত থেক বনানী, ঢাকা থেকে ফ্রাঙ্কফুর্ট
তবু তুমি চলে যাবে বলতেই বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে
সেই থেকে অবিরাম কেবল পাড় ভাঙার শব্দ শুনি
পাতা ঝরার শব্দ শুনি-
আর কিছুই শুনি না।

মন ভালো নেই - মহাদেব সাহা

বিষাদ ছুঁয়েছে আজ, মন ভালো নেই,
মন ভালো নেই;
ফাঁকা রাস্তা, শূন্য বারান্দা
সারাদিন ডাকি সাড়া নেই,
একবার ফিরেও চায় না কেউ
পথ ভুলকরে চলে যায়, এদিকে আসে না
আমি কি সহস্র সহস্র বর্ষ এভাবে
তাকিয়ে থাকবো শূন্যতার দিকে?
এই শূন্য ঘরে, এই নির্বসনে
কতোকাল, আর কতোকাল!
আজ দুঃখ ছুঁয়েছে ঘরবাড়ি,
উদ্যানে উঠেচে ক্যাকটাস্
কেউ নেই, কড়া নাড়ার মতো কেউ নেই,
শুধু শূন্যতার এই দীর্ঘশ্বাস, এই দীর্ঘ পদধ্বনি।
টেলিফোন ঘোরাতে ঘোরাতে আমি ক্লান্ত
ডাকতে ডাকতে একশেষ;
কেউ ডাক শোনে না, কেউ ফিরে তাকায় না
এই হিমঘরে ভাঙা চেয়ারে একা বসে আছি।
এ কী শান্তি তুমি আমাকে দিচ্ছো ঈশ্বর,
এভাবে দগ্ধ হওয়ার নাম কি বেঁচে থাকা!
তবু মানুষ বেঁচে থাকতে চায়, আমি বেঁচে থাকতে চাই
আমি ভালোবাসতে চাই, পাগলের মতো
ভালোবাসতে চাই-
এই কি আমার অপরাধ!
আজ বিষাদ ছুঁয়েছে বুক, বিষাদ ছুঁয়েছে বুক
মন ভালো নেই, মন ভালো নেই;
তোমার আসার কথা ছিলো, তোমার যাওয়ার
কথা ছিল-
আসা-যাওয়ার পথের ধারে
ফুল ফোটানো কথা ছিলো
সেসব কিছুই হলো না, কিছুই হলো না;
আমার ভেতরে শুধু এক কোটি বছর ধরে অশ্রুপাত
শুধু হাহাকার
শুধু শূন্যতা, শূন্যতা।
তোমার শূন্য পথের দিকে তাকাতে তাকাতে
দুই চোখ অন্ধ হয়ে গেলো,
সব নদীপথ বন্ধ হলো, তোমার সময় হলো না-
আজ সারাদিন বিষাদপর্ব, সারাদিন তুষারপাত-
মন ভালো নেই, মন ভালো নেই।

শনিবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৪

দূর থেকে হয় না - তসলিমা নাসরিন

কাছে আসতে হয়,
কাছে এসে চুমু খেতে হয়,
ত্বক স্পর্শ করে ভালোবাসতে হয়,
চুল থেকে শুরু করে চোখ নাক চিবুক, বুক,
পেট তলপেট,
যৌনাঙ্গ,
পা, পায়ের নখ একটু একটু করে ছুঁতে হয়,
ছুঁয়ে ছুঁয়ে প্রেম করতে হয়।

দূর থেকে হয় না,
ফোনে ফেসবুকে হয় না,
তার চেয়ে কাছে এসো, স্পর্শ করো,
তোমার স্পর্শের অপেক্ষায় আমার সর্বাঙ্গ।

যদি আগুন থাকতে থাকতে স্পর্শ না করো,
যদি না তাপাও শরীর,
না পোড়াও,
না ভাঙো,
উন্মাদ না করো
তবে আর এসো না,
দূর থেকে হয় না সব।

কাছে এসে হাতে হাত রেখে,
চোখে চোখ রেখে,
আগুনে আগুন রেখে বলতে হয় ভালোবাসি।

শনিবার, ২২ নভেম্বর, ২০১৪

লজ্জা, ২০০০ - তসলিমা নাসরিন

পূর্ণিমাকে ধর্ষণ করছে এগারোটি মুসলমান পুরুষ, ভর দুপুরে।
ধর্ষণ করছে কারণ পূর্ণিমা মেয়েটি হিন্দু।
পূর্ণিমাকে পূর্ণিমার বাড়ির উঠোনে ফেলে ধর্ষণ করছে তারা।
পূর্ণিমার মাকে তারা ঘরের খুঁটিতে বেঁধে রেখেছে,
চোখদুটো খোলা মার, তিনি দেখতে পাচ্ছেন তার কিশোরী কন্যার বিস্ফারিত চোখ,
যন্ত্রণায় কাতর শরীর।
পূর্ণিমার বোনটি উপুড় হয়ে পড়ে আছে মাকে শক্ত করে ধরে।
উঠোনে হু ড়োহুড়ি, পূর্ণিমার মা পাথর-কণ্ঠে মিনতি করছেন, বাবারা, এক সাথে না,
একজন একজন কইরা যাও ওর কাছে।
এগারোটি উত্তেজিত পুরুষাঙ্গে তখন ধর্মের নিশান উড়ছে।
পূর্ণিমার কান্না ছাপিয়ে পূর্ণিমার মার, গ্রামের কুলবধূটির তুমুল চিৎকারে তখন দুপুর
দ্বিখণ্ডিত, তিনি ভিক্ষে চাইছেন বাবাদের কাছে, –‘যা করার আমারে করো, ওরে ছাইড়া দেও।’

মুসলমানেরা পূর্ণিমাকে ছেড়ে দেয়নি,
পূর্ণিমার মাকেও দেয়নি,
ছ বছর বয়সী ছোট বোনটিকেও দেয়নি।

কাব্যগ্রন্থ - কিছুক্ষণ থাকো (২০০৫)।

বৃহস্পতিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০১৪

তোমাকে ভুলতে চেয়ে আরো বেশি ভালোবেসে ফেলি - মহাদেব সাহা

তোমাকে ভুলতে চেয়ে আরো বেশি ভালোবেসে ফেলি
তোমাকে ছাড়াতে গিয়ে আরো বেশি গভীরে জড়াই,
যতোই তোমাকে ছেড়ে যেতে চাই দূরে
ততোই তোমার হাতে বন্দি হয়ে পড়ি
তোমাকে এড়াতে গেলে এভাবেই আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে যাই
এভাবেই সম্পূর্ণ আড়ষ্ট হয়ে পড়ি;
তোমাকে ছাড়াতে গেলে আরো ক্রমশ জড়িয়ে যাই আমি
আমার কিছুই আর করার থাকে না
তুমি এভাবেই বেঁধে ফেলো যদি দূরে যেতে চাই
যদি ডুবে যেতে চাই তুমি দুহাতে জাগাও।
এমন সাধ্য কী আছে তোমার চোখের সামান্য আড়াল হই,
দুই হাত দূরে যাই
যেখানেই যেতে চাই সেখানেই বিছিয়ে রেখেছো ডালপালা,
তোমাকে কি অতিক্রম করা কখনও সম্ভব
তুমি সমুদ্রের চেয়েও সমুদ্র
আকাশের চেয়েও আকাশ তুমি আমার ভেতরে জেগে আছো।
তোমাকে ভুলতে চেয়ে তাই আরো বেশি
ভালোবেসে ফেলি,
তোমাকে ঠেলতে গিয়ে দূরে আরো কাছে টেনে নেই
যতোই তোমার কাছ থেকে আমি দূরে যেতে চাই
ততো মিশে যাই নি:ম্বাসে প্রশ্বাসে,
ততোই তোমার আমি হয়ে পড়ি ছায়ার মতন;
কোনোদিকে যাওয়ার আর একটুও জায়গা থাকে না
তুমিই জড়িয়ে রাখো তোমার কাঁটায়।
তোমাকে ছাড়তে গিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে আরো জড়িয়েছি
তোমাকে ভুলতে গিয়ে আরো ভালোবেসেছি
তোমাকে।

ভালোবাসা - মঞ্জুষ দাশগুপ্ত

হাত পেতে আছি দাও
চোখ পেতে আছি দাও
বুক পেতে আছি দাও

অবহেলা দাও      অপেক্ষা দাও
বিশবাঁও জলে
আমাকে ডোবাও
তুলে এনে ফের
আমাকে ঘোরাও
যাক ঘুরে যাক
নাগর দোলাও
দাও তুমি দাও      অপমান দাও
চাও বা না চাও     নাও
পুড়ে খাঁটি সোনা নাও
আঁচলে বেঁধো না তাও

এতো তুচ্ছতা প্রাপ্য আমার?
সিঁড়ি খুঁজে চলি নরকে নামার।
অন্ধ ভ্রমর গেঁথেছে অমর
শব্দপুঞ্জ ডানায় তোমার
কী অর্থ তার বুঝবে কী আর!
সিঁড়ি খুঁজে চলি নরকে নামার।
শুধু ধ্রুবপদ তোমাকে দিলাম
ভালোবাসা নাও ভালোবাসা নাও
তোমার জন্য জীবন নিলাম
করেছি বলেই
শুধু শূন্যতা বিনিময়ে দাও…

হাত পেতে আছি দাও
চোখ পেতে আছি দাও
বুক পেতে আছি তাও…

বুধবার, ১২ নভেম্বর, ২০১৪

মুক্তিযুদ্ধের কবিতা – বুদ্ধদেব বসু

আজ রাত্রে বালিশ ফেলে দাও, মাথা রাখো পরস্পরের বাহুতে,
শোনো দূরে সমুদ্রের স্বর, আর ঝাউবনে স্বপ্নের মতো নিস্বন,
ঘুমিয়ে পোড়ো না, কথা ব’লেও নষ্ট কোরো না এই রাত্রি-
শুধু অনুভব করো অস্তিত্ব।

কেন না কথাগুলোকে বড়ো নিষ্ঠুরভাবে চটকানো হ’য়ে গেছে,
কোনো উক্তি নির্মল নয় আর, কোনো বিশেষণ জীবন্ত নেই;
তাই সব ঘোষণা এত সুগোল, যেন দোকানের জানালায় পুতুল-
অতি চতুর রবারে তৈরি, রঙিন।

কিন্তু তোমরা কেন ধরা দেবে সেই মিথ্যায়, তোমরা যারা সম্পন্ন,
তোমরা যারা মাটির তলায় শস্যের মতো বর্ধিষ্ণু?
বোলো না ‘সুন্দর’, বোলো না ‘ভালোবাসা’, উচ্ছ্বাস হারিয়ে ফেলো না
নিজেদের-
শুধু আবিষ্কার করো, নিঃশব্দে।

আবিষ্কার করো সেই জগৎ, যার কোথাও কোনো সীমান্ত নেই,
যার উপর দিয়ে বাতাস ব’য়ে যায় চিরকালের সমুদ্র থেকে,
যার আকাশে এক অনির্বাণ পুঁথি বিস্তীর্ণ-
নক্ষত্রময়, বিস্মৃতিহীন।

আলিঙ্গন করো সেই জগৎকে, পরষ্পরের চেতনার মধ্যে নিবিড়।
দেখবে কেমন ছোটো হ’তেও জানে সে, যেন মুঠোর মধ্যে ধ’রে যায়,
যেন বাহুর ভাঁজে গহ্বর, যেখানে তোমরা মুখ গুঁজে আছো
অন্ধকারে গোপনতায় নিস্পন্দ-

সেই একবিন্দু স্থান, যা পবিত্র, আক্রমণের অতীত,
যোদ্ধার পক্ষে অদৃশ্য, মানচিত্রে চিহ্নিত নয়,
রেডিও আর হেডলাইনের বাইরে সংঘর্ষ থেকে উত্তীর্ণ-
যেখানে কিছুই ঘটে না শুধু আছে সব

সব আছে- কেননা তোমাদেরই হৃদয় আজ ছড়িয়ে পড়লো
ঝাউবনে মর্মর তুলে, সমুদ্রের নিয়তিহীন নিস্বনে,
নক্ষত্র থেকে নক্ষত্রে, দিগন্তের সংকেতরেখায়-
সব অতীত, সব ভবিষ্যৎ আজ তোমাদের।

আমাকে ভুল বুঝোনা। আমি জানি, বারুদ কত নিরপেক্ষ,
প্রাণ কত বিপন্ন।
কাল হয়তো আগুন জ্বলবে দারুণ, হত্যা হবে লেলিহান,
যেমন আগে, অনেকবার, আমাদের মাতৃভুমি এই পৃথিবীর
মৃত্তিকায়-
চাকার ঘূর্ণনের মতো পুনরাবৃত্ত।

তবু এও জানি ইতিহাস এক শৃঙ্খল, আর আমরা চাই মুক্তি,
আর মুক্তি আছে কোন পথে, বলো, চেষ্টাহীন মিলনে ছাড়া?
মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলন, মানুষের সঙ্গে বিশ্বের-
যার প্রমাণ, যার প্রতীক আজ তোমরা।

নাজমা, শামসুদ্দিন, আর রাত্রির বুকে লুকিয়ে-থাকা যত প্রেমিক,
যারা ভোলোনি আমাদের সনাতন চুক্তি, সমুদ্র আর নক্ষত্রের সঙ্গে,
রচনা করেছো পরস্পরের বাহুর ভাঁজে আমাদের জন্য
এক স্বর্গের আভাস, অমরতায় কল্পনা :

আমি ভাবছি তোমাদের কথা আজকের দিনে, সারাক্ষণ-
সেই একটি মাত্র শিখা আমার অন্ধকারে, আমার চোখের সামনে
নিশান।
মনে হয় এই জগৎ-জোড়া দুর্গন্ধ আর অফুরান বিবমিষার বিরুদ্ধে
শুধু তোমরা আছো উত্তর, আর উদ্ধার।

শুক্রবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

এই অরণ্যে - সেতু আশরাফুল হক

মৃত্তিকা; মা আমাদের। হাজার বছরের ধর্ষিত, পদদলিত এক দাসী। আর যারা তার জারজ সন্তান, আত্মমুগ্ধ আদিমতাবোধে ইতিহাসের পাতায় নিজেকে করেছে ইডিপাসের মতো। তারা মত্ত, উলঙ্গ হয়ে খুবলে খেয়ে নিচ্ছে নিজ জননীকে। সভ্যতা থেকে আজ অনেক দূরে এই আদিম বনে আমরাও যেন ভীত কোকিল পাখি।
কত দীর্ঘ স্বর পেরিয়ে আমাদের চিৎকার শুধু নিজেকেই পরিহাস করছে। বাসন্তীর যৌবনে জড়িয়েছে জাল, আজো সে ক্রন্দসী। বোন আমার, তাকে আবার জাল দাও অথবা ফেরী করে বেড়াও কতগুলো ন্যুড ছবি।
কিশোর ভাই, তার ঝলসানো মাংসের কাবাব তুলে দাও দেবতাদের ডাইনিং টেবিলে। সদ্য-তাজা-ভাপ ওঠা পোড়া মাংসের স্বাদ পেতে তারা উদগ্রীব।
আমাদের এই অরণ্যে লুকোনোর জায়গা শেষ হয়ে গেছে। তবু জারজের উল্লম্ফন দেখে দেখেও আমাদের বোধোদয় ঘটেনি। আমরা কেবল তুলে দিচ্ছি নিজেকেই প্রকাণ্ড সিংহের গুহায়।

বুধবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

বিদ্রোহী - কাজী নজরুল ইসলাম

বল বীর-
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারী' আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রীর!
বল বীর-

বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি'
চন্দ্র সূর্য্য গ্রহ তারা ছাড়ি'
ভূলোক দ্যূলোক গোলোক ভেদিয়া
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!
মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!

বল বীর-
আমি চির-উন্নত শির!

আমি চিরদুর্দম, দূর্বিনীত, নৃশংস,
মহাপ্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস!
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর,
আমি দূর্বার,
আমি ভেঙে করি সব চুরমার!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,
আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!
আমি মানি না কো কোন আইন,
আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!
আমি ধূর্জটী, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর
আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব-বিধাতৃর!

বল বীর-
চির-উন্নত মম শির!

আমি ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণি,
আমি পথ-সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’।
আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ,
আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ।
আমি হাম্বীর, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল,
আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’
পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’
ফিং দিয়া দেই তিন দোল্‌;
আমি চপোলা-চপোল হিন্দোল।
আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা’,
করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা,
আমি উন্মাদ, আমি ঝঞ্ঝা!
আমি মহামারী, আমি ভীতি এ ধরীত্রির;
আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ণ চির অধীর।

বল বীর-
আমি চির-উন্নত শির!

আমি চির-দূরন্ত দুর্মদ
আমি দূর্দম মম প্রাণের পেয়ালা হর্দম্‌ হ্যায় হর্দম্‌ ভরপুর্‌ মদ।
আমি হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক জমদগ্নি,
আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি।
আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান,
আমি অবসান, নিশাবসান।

আমি ঈন্দ্রাণী-সুত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ তূর্য;
আমি কৃষ্ণ-কন্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা বারিধির।
আমি ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর।

বল বীর-
চির-উন্নত মম শির!

আমি সন্ন্যাসী, সুর সৈনিক,
আমি যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক।
আমি বেদুইন, আমি চেঙ্গিস,
আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কূর্ণিশ।
আমি বজ্র, আমি ঈষাণ-বিষানে ওঙ্কার,
আমি ইস্রাফিলের শৃঙ্গার মহা-হুঙ্কার,
আমি পিনাক-পাণির ডমরু ত্রিশুল, ধর্মরাজের দন্ড,
আমি চক্র-মহাশঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচন্ড!
আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা, বিশ্বামিত্র-শিষ্য,
আমি দাবানল-দাহ, দহন করিব বিশ্ব।
আমি প্রাণ-খোলা হাসি উল্লাস, -আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস
আমি মহাপ্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু-গ্রাস!
আমি কভু প্রশান্ত, -কভু অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী,
আমি অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্পহারী!
আমি প্রভঞ্জনের উচ্ছাস, আমি বারিধির মহাকল্লোল,
আমি উজ্জ্বল, আমি প্রোজ্জ্বল,
আমি উচ্ছল জল-ছল-ছল, চল ঊর্মির হিন্দোল-দোল!-

আমি বন্ধনহারা কুমারীর বেনী, তন্বী নয়নে বহ্নি,
আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি!

আমি উন্মন, মন-উদাসীর,
আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা-হুতাশ আমি হুতাশীর।
আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির গৃহহারা যত পথিকের,
আমি অবমানিতের মরম-বেদনা, বিষ-জ্বালা, প্রিয় লাঞ্ছিত বুকে গতি ফের
আমি অভিমানী চির ক্ষূব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যাথা সূনিবিড়,
চিত চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর থর থর প্রথম পরশ কুমারীর!
আমি গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল ক’রে দেখা অনুখন,
আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা, তাঁর কাঁকণ-চুড়ির কন্‌-কন্‌।
আমি চির শিশু, চির কিশোর,
আমি যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচর কাঁচুলি নিচোর!
আমি উত্তর-বায়ু মলয়-অনিল উদাস পূরবী হাওয়া,
আমি পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীণে গান গাওয়া।
আমি আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র-রুদ্র রবি
আমি মরু-নির্ঝর ঝর-ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়াছবি!
আমি তুরীয়ানন্দে ছুটে চলি, এ কি উন্মাদ আমি উন্মাদ!
আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!

আমি উত্থান, আমি পতন, আমি অচেতন চিতে চেতন,
আমি বিশ্বতোরণে বৈজয়ন্তী, মানব-বিজয়-কেতন।
ছুটি ঝড়ের মতন করতালী দিয়া
স্বর্গ মর্ত্য-করতলে,
তাজী বোর্‌রাক্‌ আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার
হিম্মত-হ্রেষা হেঁকে চলে!
আমি বসুধা-বক্ষে আগ্নেয়াদ্রী, বাড়ব বহ্নি, কালানল,
আমি পাতালে মাতাল, অগ্নি-পাথার-কলরোল-কল-কোলাহল!
আমি তড়িতে চড়িয়া, উড়ে চলি জোড় তুড়ি দিয়া দিয়া লম্ফ,
আমি ত্রাস সঞ্চারি’ ভুবনে সহসা, সঞ্চারি ভূমিকম্প।

ধরি বাসুকির ফণা জাপটি’-
ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি’।

আমি দেবশিশু, আমি চঞ্চল,
আমি ধৃষ্ট, আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্ব-মায়ের অঞ্চল!
আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরী,
মহা-সিন্ধু উতলা ঘুম্‌ঘুম্‌
ঘুম্‌ চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝ্‌ঝুম
মম বাঁশরীর তানে পাশরি’।
আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী।

আমি রুষে উঠি’ ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া,
ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোযখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া!
আমি বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া!

আমি শ্রাবণ-প্লাবন-বন্যা,
কভু ধরনীরে করি বরণীয়া, কভু বিপুল ধ্বংস ধন্যা-
আমি ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা!
আমি অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি,
আমি ধূমকেতু জ্বালা, বিষধর কাল-ফণী!
আমি ছিন্নমস্তা চন্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী,
আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি!

আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময়,
আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়!
আমি মানব দানব দেবতার ভয়,
বিশ্বের আমি চির-দুর্জয়,
জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য,
আমি তাথিয়া তাথিয়া মাথিয়া ফিরি স্বর্গ-পাতাল মর্ত্য!
আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!!
আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!!

আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার
নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার!
আমি হল বলরাম-স্কন্ধে,
আমি উপাড়ি’ ফেলিব অধিন বিশ্ব অবহেলে, নব সৃষ্টির মহানন্দে

মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না-
অত্যাচারীর খড়্গ কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না-
বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত।

আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন,
আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন!
আমি খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!

আমি চির-বিদ্রোহী বীর-
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!

সোমবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৪

বৃষ্টিবিলাস - চৌধুরী ফাহাদ

তোমাকে ছুঁয়ে দেখবো বলে...
মাড়িয়ে এসেছি মুক্তোদানা পথে,
সোনালী শিহরণ,
পেরিয়ে এসেছি অবারিত আকর্ষণ,
হেমন্ত আবরণ।
কণকণে মাদলে অপেক্ষা করেছি
সহস্র শৈত্যপ্রতাপ,
ছাড়িয়ে এসেছি কুয়াশা আলিঙ্গন
সোনা রোদ্দুরে সোনা আহ্বান।
তোমাকে ছুঁয়ে দেখবো বলে...
পাড়ি দিয়েছি অজস্র ফাগুণের বন,
ঘুরেছি শত বসন্ত বাগান।
তোমাকে ছুঁয়ে দেখবো বলে...
আকণ্ঠ তৃষ্ণায় অনন্তকাল
দাঁড়িয়ে রয়েছি গ্রীষ্ম শহরে।

অবশেষে তুমি এলে।
তুমি এলে ছেড়ে মেঘমাল্লার শ্বাস,
আকাশের ওপারে আকাশ।
আকাঙ্ক্ষার অনু বর্ষণে ছুঁয়ে দিলে
তপ্ত কপোলের ঢাল,
ছুঁয়ে দিলে অপেক্ষা পাহাড়।
তোমার স্মিত সুহাস আলিঙ্গনে,
ছুঁয়ে দিলে প্রিয়তমাসু মন।

ভালোবাসবো ...রত্নদীপা দে ঘোষ

এতো ভালবাসবো তোমাকে যে
ঠিক সূর্য ওঠার সময়
একটার পর একটা চুমু
ঝমঝম করবে সরোবরে , দোয়েল পাখি
শিস দেবে ক্রমাগত , ভাসবে পালক
চেটেপুটে সূর্যালোক উড়বে
মিহি কারুকাজে ! ক্লান্তি তে ঠোঁটে নামবে বিকেল ,
হাই তুলবে
মোরগঝুঁটি ফুল ,
এতো ভালবাসবো তোমাকে ...

মাঝরাতে ঘুম না এলে
কোনো কোনো দিন , বখাটে চাঁদ টা সম্পূর্ণ
লোপাট হয়ে যায় মিসিসিপি তে ,
রক্ত চলাচলে বাধা পরে আমার , তুমি
ঐ শালপাইনের জঙ্গলে যেও না আর !
এমন মৃত্যুর পর
আমি যেন ঝরনার সাথে
লুকোচুরি খেলি !

আজ রাতে
যখন জানালামুখো আকাশে
উঠবে চাঁদ , নাভিতে তামাম কোলাহল ,
তখন
এতো ভালবাসবো তোমাকে ...
এতো ভালবাসবো ...যে
আমাকে ইশ্বর বলে মনে হবে ......

সত্যবদ্ধ অভিমান - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
আমি কি এ হাতে কোনো পাপ করতে পারি ?
শেষ বিকেলের সেই ঝুল বারান্দায়
তার মুখে পড়েছিল দুর্দান্ত সাহসী এক আলো
যেন এক টেলিগ্রাম, মুহূর্তে উন্মুক্ত করে
নীরার সুষমা
চোখে ও ভুরুতে মেশা হাসি, নাকি অভ্রবিন্দু ?
তখন সে যুবতীকে খুকি বলে ডাকতে ইচ্ছে হয়--
আমি ডান হাত তুলি, পুরুষ পাঞ্জার দিকে
মনে মনে বলি,
যোগ্য হও, যোগ্য হয়ে ওঠো--
ছুঁয়ে দিই নীরার চিবুক
এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
আমি কি এ হাতে আর কোনোদিন
পাপ করতে পারি ?

এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে , ভালোবাসি--
এই ওষ্ঠে আর কোনো মিথ্যে কি মানায় ?
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনে পড়ে ভীষণ জরুরী
কথাটাই বলা হয়নি
লঘু মরালীর মতো নারীটিকে নিয়ে যাবে বিদেশী বাতাস
আকস্মিক ভূমিকম্পে ভেঙ্গে যাবে সবগুলো সিঁড়ি
থমকে দাঁড়িয়ে আমি নীরার চোখের দিকে....
ভালোবাসা এক তীব্র অঙ্গীকার, যেন মায়াপাশ
সত্যবদ্ধ অভিমান--চোখ জ্বালা করে ওঠে,
সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে
এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে, ভালোবাসি--
এই ওষ্ঠে আর কোন মিথ্যে কি মানায় ?

নির্জন স্বাক্ষর - জীবনানন্দ দাশ

তুমি তা জানো না কিছু, না জানিলে-
আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য ক’রে!
যখন ঝরিয়া যাব হেমন্তের ঝড়ে,
পথের পাতার মতো তুমিও তখন
আমার বুকের ‘পরে শুয়ে রবে?
অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন
সেদিন তোমার!
তোমার এ জীবনের ধার
ক্ষয়ে যাবে সেদিন সকল?
আমার বুকের ’পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল,
তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই!-
শুধু তার স্বাদ
তোমারে কি শান্তি দেবে!
আমি ঝরে যাব, তবু জীবন অগাধ
তোমারে রাখিবে ধরে সেইদিন পৃথিবীর’ পরে-
আমার সকল গান ও তবুও তোমারে লক্ষ্য ক’রে!

রয়েছি সবুজ মাঠে-ঘাসে-
আকাশ ছড়ায়ে আছে নীল হয়ে আকাশে আকাশে।
জীবনের রঙ তবু ফলানো কি হয়
এই সব ছুঁয়ে ছেনে!-সে এক বিস্ময়
পৃথিবীতে নাই তাহা – আকাশেও নাই তার স্থল-
চেনে নাই তারে অই সমুদ্রের জল!
রাতে রাতে হেঁটে হেঁটে নক্ষত্রের সনে
তারে আমি পাই নাই, কোনো এক মানুষীর মনে
কোনো এক মানুষের তরে
যে জিনিস বেঁচে থাকে হৃদয়ের গভীর গহ্বরে!-
নক্ষত্রের চেয়ে আরো নিঃশব্দে আসনে
কোনো এক মানুষের তরে এক মানুষীর মনে!

একবার এথা ক’য়ে দেশ আর দিকের দেবতা
বোবা হয়ে পড়ে থাকে–ভুলে যায় কথা!
যে-আগুন উঠেছিল তাদের চোখের তলে জ্ব’লে
নিভে যায় — ডুবে যায় — তারা যায় স্খ’লে!
নতুন আকাঙক্ষা আসে — চলে আসে নতুন সময়
পুরনো সে নক্ষত্রের দিন শেষ হয়,
নতুনেরা আসিতেছে ব’লে!–
আমার বুকের থেকে তবুও কি পড়িয়াছে স্খ’লে
কোনো এক মানুষীর তরে
যেই প্রেম জ্বালায়েছি পুরোহিত হ’য়ে তার বুকের উপরে!

আমি সেই পুরোহিত– সেই পুরোহিত!–
যে নক্ষত্র মরে যায়, তাহার বুকের শীত
লাগিতেছে আমার শরীরে–
যেই তারা জেগে আছে, তার দিকে ফিরে
তুমি আছো জেগে–
যে আকাশে জ্বলিতেছে, তার মতো মনের আবেগে
জেগে আছো–
জানিয়াছে তুমি এক নিশ্চয়তা — হয়েছ নিশ্চয়!
হয়ে যায় আকাশের তলে কত আলো-কত আগুনের ক্ষয়;
কতবার বর্তমান হ’য়ে গেছে ব্যথিত অতীত–
তবুও তোমার বুকে লাগে নাই শীত
যে নক্ষত্র ঝরে যায় তার!
যে পৃথিবী জেগে আছে, তার ঘাস– আকাশ তোমার!
জীবনের স্বাদ লয়ে জেগে আছ– তবুও মৃত্যুর ব্যথা দিতে
পার তুমি;
তোমার আকাশের তুমি উষ্ণ হয়ে আছ, তবু–
বাহিরের আকাশের শীতে
নক্ষত্রের হইতেছে ক্ষয়,
নক্ষত্রের মতন হৃদয়
পড়িতেছে ঝ’রে–
ক্লান্ত হয়ে– শিশিরের মতো শব্দ ক’রে!
জানো নাকো তুমি তার স্বাদ,
তোমারে নিতেছে ডেকে জীবন অবাধ,
জীবন অগাধ!
হেমন্তের ঝড়ে আমি ঝরিব যখন–
পথের পাতার মতো তুমিও তখন
আমার বুকে পরে শুয়ে রবে? — অনেক ঘুমের ঘোরে ভরিবে কি মন
সেদিন তোমার!
তোমার আকাশ — আলো — জীবনের ধার
ক্ষয়ে যাবে সেদিন সকল?
আমার বুকের পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল
তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই! শুধু তার স্বাদ
তোমারে কি শান্তি দেবে!
আমি চ’লে যাব — তবু জীবন অগাধ
তোমারে রাখিবে ধরে সেই দিন পৃথিবীর ‘পরে;–
আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য ক’রে!

যা চেয়েছি যা পাবো না - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

যা চেয়েছি, যা পাবো না
-কী চাও আমার কাছে ?
-কিছু তো চাইনি আমি ।
-চাওনি তা ঠিক । তবু কেন
এমন ঝড়ের মতো ডাক দাও ?
-জানি না । ওদিকে দ্যাখো
রোদ্দুরে রুপোর মতো জল
তোমার চোখের মতো
দূরবর্তী নৌকো
চর্তুদিকে তোমাকেই দেখা
-সত্যি করে বলো, কবি, কী চাও আমার কাছে ?
-মনে হয় তুমি দেবী...
-আমি দেবী নই ।
-তুমি তো জানো না তুমি কে !
-কে আমি !
-তুমি সরস্বতী, শব্দটির মূল অর্থে
যদিও মানবী, তাই কাছাকাছি পাওয়া
মাঝে মাঝে নারী নামে ডাকি
-হাসি পায় শুনে । যখন যা মনে আসে
তাই বলো, ঠিক নয় ?
-অনেকটা ঠিক । যখন যা মনে আসে-
কেন মনে আসে ?
-কী চাও, বলো তো সত্যি ? কথা ঘুরিয়ো না
-আশীর্বাদ !
-আশীর্বাদ ? আমার, না সত্যি যিনি দেবী
-তুমিই তো সেই ! টেবিলের ঐ পাশে
ফিকে লাল শাড়ি
আঙ্গুলে ছোঁয়ানো থুতনি,
উঠে এসো
আশীর্বাদ দাও, মাথার ওপরে রাখো হাত
আশীর্বাদে আশীর্বাদে আমাকে পাগল করে তোলো
খিমচে ধরো চুল, আমার কপাল
নোখ দিয়ে চিরে দাও
-যথেষ্ট পাগল আছো ! আরও হতে চাও বুঝি ?
-তোমাকে দেখলেই শুধু এরকম, নয়তো কেমন
শান্তশিষ্ট
-না দেখাই ভালো তবে ! তাই নয় ?
-ভালো মন্দ জেনে শুনে যদি এ-জীবন
কাটাতুম
তবে সে-জীবন ছিল শালিকের, দোয়েলের
বনবিড়ালের কিংবা মহাত্মা গান্ধীর
ইরি ধানে, ধানের পোকার যে-জীবন
-যে জীবন মানুষের ?
-আমি কি মানুষ নাকি ? ছিলাম মানুষ বটে
তোমাকে দেখার আগে
-তুমি সোজাসুজি তাকাও চোখের দিকে
অনেকক্ষণ চেয়ে থাকো
পলক পড়ে না
কী দেখো অমন করে ?
-তোমার ভিতরে তুমি, শাড়ি-সজ্জা খুলে ফেললে
তুমি
তারা আড়ালে যে তুমি
-সে কি সত্যি আমি ? না তোমার নিজের কল্পনা
-শোন্ খুকী
-এই মাত্র দেবী বললে-
-একই কথা ! কল্পনা আধার যিনি, তিনি দেবী-
তুই সেই নীরা
তোর কাছে আশীর্বাদ চাই
-সে আর এমন কি শক্ত ? এক্ষুনি তা দিতে পারি
-তোমার অনেক আছে, কণা মাত্র দাও
-কী আছে আমার ? জানি না তো
-তুমি আছো, তুমি আছো, এর চেয়ে বড় সত্য নেই
-সিঁড়ির ওপরে সেই দেখা
তখন তো বলোনি কিছু ?
আমার নিঃসঙ্গ দিন, আমার অবেলা
আমারই নিজস্ব--শৈশবের হাওয়া শুধু জানে

-দেবে কি দুঃখের অংশভাগ ? আমি
ধনী হবো
-আমার তো দুঃখ নেই--দুঃখের চেয়েও
কোনো সুমহান আবিষ্টতা
আমাকে রয়েছে ঘিরে
তার কোনো ভাগ হয় না
আমার কী আছে আর, কী দেবো তোমাকে ?
-তুমি আছো, তুমি আছো, এর চেয়ে বড় সত্য নেই !
তুমি দেবী, ইচ্ছে হয় হাঁটু গেড়ে বসি
মাথায় তোমার করতল, আশীর্বাদ...
তবু সেখানেও শেষ নেই
কবি নয়, মুহূর্তে পুরুষ হয়ে উঠি
অস্থির দু'হাত
দশ আঙুলে আঁকড়ে ধরতে চায়
সিংহিনীর মতো ঐ যে তোমার কোমর
অবোধ শিশুর মতো মুখ ঘষে তোমার শরীরে
যেন কোনো গুপ্ত সংবাদের জন্য ছটফটানি
-পুরুষ দূরত্বে যাও, কবি কাছে এসো
তোমায় কী দিতে পারি ?
-কিছু নয় !
-অভিমান ?
-নাম দাও অভিমান !
-এটা কিন্তু বেশ ! যদি
অসুখের নাম দিই নির্বাসন
না-দেখার নাম দিই অনস্তিত্ব
দূরত্বের নাম দিই অভিমান ?
-কতটুকু দূরত্ব ? কী, মনে পড়ে ?
-কী করে ভাবলে যে ভুলবো ?
-তুমি এই যে বসে আছো, আঙুলে ছোঁয়ানো থুতনি
কপালে পড়েছে চূর্ণ চুল
পাড়ের নক্সায় ঢাকা পা
ওষ্ঠাগ্রে আসন্ন হাসি-
এই দৃশ্যে অমরত্ব
তুমি তো জানো না, নীরা,
আমার মৃত্যুর পরও এই ছবি থেকে যাবে ।
-সময় কি থেমে থাকবে ? কী চাও আমার কাছে ?
-মৃত্যু ?
-ছিঃ , বলতে নেই
-তবে স্নেহ ? আমি বড় স্নেহের কাঙাল
-পাওনি কি ?
-বুঝতে পারি না ঠিক । বয়স্ক পুরুষ যদি স্নেহ চায়
শরীরও সে চায়
তার গালে গাল চেপে দিতে পারো মধুর উত্তাপ ?
-ফের পাগলামি ?
-দেখা দাও ।
-আমিও তোমায় দেখতে চাই ।
-না !
-কেন ?
-বোলো না । কক্ষনো বোলো না আর এ কথা
আমি ভয় পাবো ।
এ শুধুই এক দিকের
আমি কে ? সামান্য, অতি নগণ্য, কেউ না
তুবি এত স্পর্ধা করে তোমার রূপের কাছে--
-তুমি কবি ?
-তা কি মনে থাকে ? বারবার ভুলে যাই
অবুঝ পুরুষ হয়ে কৃপাপ্রার্থী
-কী চাও আমার কাছে ?
-কিছু নয় । আমার দু'চোখে যদি ধুলো পড়ে
আঁচলের ভাপ দিয়ে মুছে দেবে ?

অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অমন আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
চলবে না।
এবার হৃদয় মাঝে লুকিয়ে বোসো,
কেউ জানবে না, কেউ বলবে না।
বিশ্বে তোমার লুকোচুরি,
দেশ বিদেশে কতই ঘুরি -
এবার বলো আমার মনের কোণে
দেবে ধরা, ছলবে না।
আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
চলবে না।

জানি আমার কঠিন হৃদয়
চরণ রাখার যোগ্য সে নয় -
সখা, তোমার হাওয়া লাগলে হিয়ায়
তবু কি প্রাণ গলবে না।

না হয় আমার নাই সাধনা,
ঝরলে তোমার কৃপার কণা
তখন নিমেষে কি ফুটবে না ফুল
চকিতে ফল ফলবে না।
আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে
চলবে না।

চিঠি দিও - মহাদেব সাহা

করুণা করে হলেও চিঠি দিও, খামে ভরে তুলে দিও
আঙ্গুলের মিহিন সেলাই

ভুল বানানেও লিখো প্রিয়, বেশি হলে কেটে ফেলো তাও,
এটুকু সামান্য দাবি, চিঠি দিও, তোমার শাড়ির মতো
অক্ষরের পাড়-বোনা একখানি চিঠি।

চুলের মতন কোনো চিহ্ন দিও বিস্ময় বোঝাতে যদি চাও ...
বর্ণণা আলস্য লাগে তোমার চোখের মতো চিহ্ন কিছু দিও!

আজো তো অমল আমি চিঠি চাই, পথ চেয়ে আছি,
আসবেন অচেনা রাজার লোক
তার হাতে চিঠি দিও, বাড়ি পৌঁছে দেবে ....
এমন ব্যস্ততা যদি শুদ্ধ করে একটি শব্দই শুধু লিখো, তোমার কুশল! ...

করুণা করে হলেও চিঠি দিও, ভুলে গিয়ে ভুল করে একখানি চিঠি
দিও খামে
কিছুই লেখার নেই তবু লিখো একটি পাখির শিস
একটি ফুলের ছোট নাম,

টুকিটাকি হয়তো হারিয়ে গেছে কিছু, হয়তো পাওনি খুঁজে
সেইসব চুপচাপ কোন দুপুরবেলার গল্প
খুব মেঘ করে এলে কখনো কখনো বড় একা লাগে, তাই লিখো

করুণা করে হলেও চিঠি দিও, মিথ্যা করে হলেও বোলো, ভালবাসি !

আবৃত্তিঃ https://soundcloud.com/shamsuzzoha/chithi-dio

ওটা কিছু নয় - নির্মলেন্দু গুণ

এইবার হাত দাও, টের পাচ্ছো আমার অস্তিত্ব ? পাচ্ছো না ?
একটু দাঁড়াও আমি তৈরী হয়ে নিই ।
এইবার হাত দাও, টের পাচ্ছো আমার অস্তিত্ব ? পাচ্ছো না ?
তেমার জন্মান্ধ চোখে শুধু ভুল অন্ধকার । ওটা নয়, ওটা চুল ।
এই হলো আমার আঙ্গুল, এইবার স্পর্শ করো,–না, না, না,
-ওটা নয়, ওটা কন্ঠনালী, গরলবিশ্বাসী এক শিল্পীর
মাটির ভাস্কর্য, ওটা অগ্নি নয়, অই আমি–আমার যৌবন ।

সুখের সামান্য নিচে কেটে ফেলা যন্ত্রণার কবন্ধ–প্রেমিক,
ওখানে কী খোঁজ তুমি ? ওটা কিছু নয়, ওটা দুঃখ ;
রমণীর ভালোবাসা না-পাওয়ার চিহ্ন বুকে নিয়ে ওটা নদী,
নীল হয়ে জমে আছে ঘাসে,–এর ঠিক ডানপাশে , অইখানে
হাত দাও, হ্যাঁ, ওটা বুক, অইখানে হাত রাখো, ওটাই হৃদয় ।

অইখানে থাকে প্রেম, থাকে স্মৃতি, থাকে সুখ, প্রেমের সিম্পনি ;
অই বুকে প্রেম ছিল, স্মৃতি ছিল, সব ছিল তুমিই থাকো নি ।

মঙ্গলবার, ২৬ আগস্ট, ২০১৪

স্নান - জয় গোস্বামী

সংকোচে জানাই আজ: একবার মুগ্ধ হতে চাই।
তাকিয়েছি দূর থেকে। এতদিন প্রকাশ্যে বলিনি।
এতদিন সাহস ছিল না কোনো ঝর্ণাজলে লুণ্ঠিত হবার -
আজ দেখি অবগাহনের কাল পেরিয়ে চলেছি দিনে দিনে ...

জানি, পুরুষের কাছে দস্যুতাই প্রত্যাশা করেছো।
তোমাকে ফুলের দেশে নিয়ে যাবে ব'লে যে-প্রেমিক
ফেলে রেখে গেছে পথে, জানি, তার মিথ্যে বাগদান
হাড়ের মালার মতো এখনো জড়িয়ে রাখো চুলে।

আজ যদি বলি, সেই মালার কঙ্কালগ্রন্থি আমি
ছিন্ন করবার জন্য অধিকার চাইতে এসেছি? যদি বলি
আমি সে-পুরুষ, দ্যাখো, যার জন্য তুমি এতকাল
অক্ষত রেখেছো ওই রোমাঞ্চিত যমুনা তোমার?

শোনো, আমি রাত্রিচর। আমি এই সভ্যতার কাছে
এখনো গোপন ক'রে রেখেছি আমার দগ্ধ ডানা;
সমস্ত যৌবন ধ'রে ব্যধিঘোর কাটেনি আমার। আমি একা
দেখেছি ফুলের জন্ম মৃতের শয্যার পাশে বসে,
জন্মান্ধ মেয়েকে আমি জ্যোৼস্নার ধারণা দেব ব'লে
এখনো রাত্রির এই মরুভুমি জাগিয়ে রেখেছি।

দ্যাখো, সেই মরুরাত্রি চোখ থেকে চোখে আজ পাঠালো সংকেত -
যদি বুঝে থাকো তবে একবার মুগ্ধ করো বধির কবিকে;
সে যদি সংকোচ করে, তবে লোকসমক্ষে দাঁড়িয়ে
তাকে অন্ধ করো, তার দগ্ধ চোখে ঢেলে দাও অসমাপ্ত চুম্বন তোমার...
পৃথিবী দেখুক, এই তীব্র সূর্যের সামনে তুমি
সভ্য পথচারীদের আগুনে স্তম্ভিত ক'রে রেখে
উন্মাদ কবির সঙ্গে স্নান করছো প্রকাশ্য ঝর্ণায়।

শনিবার, ৫ এপ্রিল, ২০১৪

পরানের গহীন ভিতর - সৈয়দ শামসুল হক




জামার ভিতর থিকা যাদুমন্ত্রে বারায় ডাহুক,

চুলের ভিতর থিকা আকবর বাদশার মোহর,

মানুষ বেবাক চুপ, হাটবারে সকলে দেখুক

কেমন মোচর দিয়া টাকা নিয়া যায় বাজিকর।

চক্ষের ভিতর থিকা সোহাগের পাখিরে উড়াও,

বুকের ভিতর থিকা পিরীতের পুন্নিমার চান,

নিজেই তাজ্জব তুমি একদিকে যাইবার চাও

অথচ আরেক দিকে খুব জোরে দেয় কেউ টান।

সে তোমার পাওনার এতটুকু পরোয়া করে না,

খেলা যে দেখায় তার দ্যাখানের ইচ্ছায় দেখায়,

ডাহুক উড়াইয়া দিয়া তারপর আবার ধরে না,

সোনার মোহর তার পড়ে থাকে পথের ধুলায়।

এ বড় দারুণ বাজি, তারে কই বড় বাজিকর

যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর।।





আন্ধার তোরঙ্গে তুমি সারাদিন কর কি তালাশ?

মেঘের ভিতর তুমি দ্যাখ কোন পাখির চক্কর?

এমন সরল পথ তবু ক্যান পাথরে টক্কর?

সোনার সংসার থুয়া পাথারের পরে কর বাস?

কি কামে তোমার মন লাগে না এ বাণিজ্যের হাটে?

তোমার সাক্ষাৎ পাই যেইখানে দারুণ বিরান,

ছায়া দিয়া ঘেরা আছে পরিস্কার তোমার উঠান

অথচ বেবাক দেখি শোয়া আছে মরনের খাটে।

নিঝুম জঙ্গলে তুমি শুনছিলা ধনেশের ডাক?

হঠাৎ আছাড় দিয়া পড়ছিল রূপার বাসন?

জলপির গাছে এক কুড়ালের কোপের মতন

তাই কি তোমার দেহে ল্যাখা তিন বাইন তালাক?

এমন বৃক্ষ কি নাই, যার ডালে নাই কোন পরী?

এমন নদী কি নাই, যার বুকে নাই কোন তরী?





সে কোন বাটিতে কও দিয়াছিলা এমন চুমুক

নীল হয়া গ্যাছে ঠোঁট, হাত পাও শরীল অবশ,

অথচ চাও না তুমি এই ব্যাধি কখনো সারুক।

আমার জানতে সাধ, ছিল কোন পাতার সে রস?

সে পাতা পানের পাতা মানুষের হিয়ার আকার?

নাকি সে আমের পাতা বড় কচি ঠোঁটের মতন?

অথবা বটের পাতা অবিকল মুখের গড়ন?

তুঁতের পাতা কি তয়, বিষনিম, নাকি ধুতুরার?

কতবার গেছি আমি গেরামের শ্যাষ সীমানায়

আদাড় বাদার দিয়া অতিঘোর গহীন ভিতরে,

কত না গাছের পাতা কতবার দিয়াছি জিহ্বায়,

এমন তো পড়ে নাই পানি এই পরানে, শিকড়ে।

তয় কি অচিন বৃক্ষ তুমি সেই ভুবনে আমার,

আমারে দিয়াছো ব্যাধি, নিরাময় অসম্ভব যার?





আমি কার কাছে গিয়া জিগামু সে দুঃখ দ্যায় ক্যান,

ক্যান এত তপ্ত কথা কয়, ক্যান পাশ ফিরা শোয়,

ঘরের বিছান নিয়া ক্যান অন্য ধানখ্যাত রোয়?

অথচ বিয়ার আগে আমি তার আছিলাম ধ্যান।

আছিলাম ঘুমের ভিতরে তার য্যান জলপিপি,

বাঁশির লহরে ডোবা পরানের ঘাসের ভিতরে,

এখন শুকনা পাতা উঠানের পরে খেলা করে,

এখন সংসার ভরা ইন্দুরের বড় বড় ঢিপি।

মানুষ এমন ভাবে বদলায়া যায়, ক্যান যায়?

পুন্নিমার চান হয় অমাবস্যা কিভাবে আবার?

সাধের পিনিস ক্যান রঙচটা রদ্দুরে শুকায়?

সিন্দুরমতির মেলা হয় ক্যান বিরান পাথার?

মানুষ এমন তয়, একবার পাইবার পর

নিতান্ত মাটির মনে হয় তার সোনার মোহর।।





তোমার দ্যাশের দিকে ইস্টিশানে গেলেই তো গাড়ি

সকাল বিকাল আসে, এক দন্ড খাড়ায়া চম্পট,

কত লোক কত কামে দূরে যায়, ফিরা আসে বাড়ি-

আমার আসন নাই, যাওনেরও দারুন সংকট।

আসুম? আসার মতো আমি কোনো ঘর দেখি নাই।

যামু যে? কোথায় যামু, বদলায়া গ্যাছে যে বেবাক।

কেমন তাজ্জব সব পাল্টায়া যায় আমি তাই

দেইখাছি চিরকাল। পরানের ভিতরে সুরাখ-

সেখানে কেবল এক ফরফর শব্দ শোনা যায়,

পাখিরা উড়াল দিয়া গ্যাছে গিয়া, এখন বিরান,

এখন যতই আমি ছড়া দেই কালিজিরা ধান,

সে কি আর আঙিনায় ফিরা আসে? আর কি সে খায়?

সকাল বিকাল গাড়ি, চক্ষু আছে তাই চক্ষে পড়ে;

পলকে পলকে গাড়ি সারাদিন মনের ভিতরে।।





তোমার খামাচির দাগ এখনো কি টকটাকা লাল,

এখনো জ্বলন তার চোৎরার পাতার লাহান।

শয়তান, দ্যাখো না করছ কি তুমি কি সোন্দর গাল,

না হয় দুপুর বেলা একবার দিছিলাম টান?

না হয় উঠানে ছিল লোকজন কামের মানুষ,

চুলায় আছিল ভাত, পোলাপান পিছের বাগানে,

তোমারে পরান দিছি, তাই বইলা দেই নাই হুঁশ,

আমি তো তোমারে নিতে চাই নাই ঘরের বিছানে।

হ, জানি নিজের কাছে কোনো কথা থাকে না গোপন।

দিনের দুফুর বেলা যেই তুমি আসছিলা ঘরে

আতখা এমন মনে হইছিল- আন্ধার যেমন,

আতখা এমন ছায়া সোহাগের আর্শির ভিতরে।

আবার ডাকলে পরে কিছুতেই স্বীকার হমু না।

বুকের পাষাণ নিয়া দিমু ডুব শীতল যমুনা।।





নদীর কিনারে গিয়া দেখি নাও নিয়া গ্যাছে কেউ

অথচ এই তো বান্ধা আছিল সে বিকাল বেলায়।

আমার অস্থির করে বুঝি না কে এমন খেলায়,

আমার বেবাক নিয়া শান্তি নাই, পাচে পাছে ফেউ।

পানির ভিতরে য্যান ঘুন্নি দিয়া খিলখিল হাসে

যত চোর যুবতীরা, গ্যারামের শ্যাষ সীমানায়

বটের বৈরাগী চুল, ম্যাঘে চিল হারায় বারায়,

বুকের ভিতরে শিস দিয়া সন্ধা হাঁটে আশেপাশে।

এখন কোথায় যাই, এইখানে বড় সুনসান,

মানুষের দুঃখ আছে, জগতের আছে কিনা জানি না-

জগৎ এমনভাবে হয়া যায় হঠাৎ অচিনা।

মনে হয় আমার থিকাও একা বৃক্ষের পরান,

আমার থিকাও দুঃখী যমুনার নদীর কিনার।

আমার তো গ্যাছে এক, কত কোটি লক্ষ গ্যাছে তার।।





আমারে তলব দিও দ্যাখো যদি দুঃখের কাফন

তোমারে পিন্ধায়া কেউ অন্যখানে যাইবার চায়

মানুষ কি জানে ক্যান মোচড়ায় মানুষের মন,

অহেতুক দুঃখ দিয়া কেউ ক্যান এত সুখ পায়?

নদীরে জীবন কই, সেই নদী জল্লাদের মতো

ক্যান শস্য বাড়িঘর জননীর শিশুরে ডুবায়?

যে তারে পরান কই, সেই ব্যাক্তি পাইকের মতো

আমার উঠানে ক্যান নিলামের ঢোলে বাড়ি দ্যায়?

যে পারে উত্তর দিতে তার খোঁজে দিছি এ জীবন,

দ্যাখা তার পাই নাই, জানা নাই কি এর উত্তর।

জানে কেউ? যে তুমি আমার সুখ, তুমিই কি পারো

আমারে না দুঃখ দিয়া? একবার দেখি না কেমন?

কেমন না যায়া তুমি পারো দেখি অপরের ঘর?-

অপর সন্ধান করে চিরকাল অন্য ঘর কারো।।





একবার চাই এক চিক্কুর দিবার, দিমু তয়?

জিগাই কিসের সুখে দুঃখ নিয়া তুমি কর ঘর?

আঙিনার পাড়ে ফুলগাছ দিলে কি সোন্দর হয়,

দুঃখের কুসুম ঘিরা থাকে যার, জীয়ন্তে কবর।

পাথারে বৃক্ষের তরে ঘন ছায়া জুড়ায় পরান,

গাঙের ভিতরে মাছ সারাদিন সাঁতরায় সুখে,

বাসরের পরে ছায়া য্যান দেহে গোক্ষুর জড়ান,

উদাস সংসারে ব্যথা সারাদিন ঘাই দেয় বুকে।

তবুও সংসার নিয়া তারে নিয়া তুমি কি পাগল,

তোলো লালশাক মাঠে, ফসফস কোটো পুঁটিমাছ,

সাধের ব্যাঞ্জন করো, রান্ধো ক্ষীর পুড়ায়া আঞ্চল,

বিকাল বেলায় কর কুঙ্কুমের ফোঁটা দিয়া সাজ।

ইচ্ছা করে টান দিয়া নিয়া যাই তোমারে রান্ধুনি,

তোমার সুতায় আমি একখান নীল শাড়ি বুনি।।



১০

কে য্যান কানতে আছে- তার শব্দ পাওয়া যায় কানে,

নদীও শুকায়া যায়, আকালের বাতাস ফোঁপায়,

মানুষেরা বাড়িঘর বানায় না আর এই খানে,

গোক্ষুর লতায়া ওঠে যুবতীর চুলের খোঁপায়।

বুকের ভিতর থিকা লাফ দিয়া ওঠে যে চিক্কুর,

আমি তার সাথে দেই শিমুলের ফুলের তুলনা,

নিথর দুফুর বেলা, মরা পাখি, রবি কি নিষ্ঠুর,

আগুন লাগায়া দিবে, হবে খাক, তারি এ সূচনা।

অথচ আমারে কও একদিন এরও শ্যাষ আছে-

আষাঢ়ের পুন্নিমার আশা আর এ দ্যাশে করি না,

চক্ষু যে খাবলা দিয়া খায় সেই পাখি বসা গাছে,

অথচ খাড়ায়া থাকি, এক পাও কোথাও নড়ি না।

সকল কলস আমি কালঘাটে শূণ্য দেইখাছি,

তারে না দেইখাছি তাই দ্যাখনের চক্ষু দিতে রাজি।।



১১

কি আছে তোমার দ্যাশে? নদী আছে? আছে নাকি ঘর?

ঘরের ভিতরে আছে পরানের নিকটে যে থাকে?

উত্তর সিথানে গাছ, সেই গাছে পাখির কোটর

আছে নাকি? পাখিরা কি মানুষের গলা নিয়া ডাকে?

যখন তোমার দ্যাখা জানা নাই পাবো কি পাবো না,

যখন গাছের তলে এই দেহ দিবে কালঘুম,

যখন ফুরায়া যাবে জীবনে নীল শাড়ি বোনা,

তখন কি তারা সব কয়া দিবে আগাম-নিগুম?

আমার তো দ্যাশ নাই, নদী নাই, ঘর নাই, লোক,

আমার বিছানে নাই সোহাগের তাঁতের চাদর,

আমার বেড়ায় খালি ইন্দুরের বড় বর ফোক,

আমার বেবাক ফুল কাফনের ইরানি আতর।

তোমার কি সাধ্য আছে নিয়া যাও এইখান থিকা,

আমার জীবন নিয়া করো তুমি সাতনরী ছিকা?



১২

উঠানের সেই দিকে আন্ধারের ইয়া লম্বা লাশ,

শিমের মাচার নিচে জোছনার সাপের ছলম,

পরীরা সন্ধান করে যুবতীর ফুলের কলম,

তারার ভিতরে এক ধুনকার ধুনায় কাপাশ,

আকাশে দোলায় কার বিবাহের রুপার বাসন,

গাবের বাবরি চুল আলখেল্লা পরা বয়াতির,

গাভির ওলান দিয়া ক্ষীণ ধারে পড়তাছে ক্ষীর,

দুই গাঙ্গ এক হয়া যাইতাছে- কান্দন, হাসন।

একবার আসবা না?- তোমারেও ডাক দিতে আছে

যে তুমি দুঃখের দিকে একা একা যোজন গিয়াছো?

একবার দেখবা না তোমারেও ডাক দিতে আছে

যে তুমি আঘাত নিয়া সারাদিন কি তফাত আছো?

যে নাই সে নাই সই, তাই সই, যা আছে তা আছে,

এমন পুন্নিমা আইজ, কোন দুঃখে দুয়ার দিয়াছো?



১৩

তোমার বিয়ার দিন মনে হইল, সত্য নিও মনে,

এত বড় এত গোল কোনোদিন দেখি নাই চান।

তুলার মতন ফুল, রাণী য্যান দরবারে বসা,

নদীর গহীন তলে জোছনায় দিয়া সে প্রাসাদ।

পাথারে নিরালা গাছ আলগোছে একখানা হাত

আমার আন্ধার পিঠে দিয়া কয়, 'তোমারে সহসা

দেখাই কিভবে সব মানুষের নিজের বানান,

পরীর সাক্ষাৎ নাই গেরস্তের বাড়ির পিছনে।'

দিঘল নায়ের মতো দুঃখ এক নদী দিয়া যায়-

মাঝি নাই, ছই নাই, নাই কোনো কেরায়া কি লোক।

না হয় অনেকে কয়- এক গেলে অন্য আর আসে,

অন্যের মধ্যে কি সেই পরানের এক পাওয়া যায়?-

তাই না সচ্ছল দ্যাশ অথচ কি বিরান সড়ক।

মানুষ বোঝে না বইলা পুন্নিমার চান এত হাসে।।



১৪

কি কামে মানুষ দ্যাখে মানুষের বুকের ভিতরে

নীল এক আসমান- তার তলে যমুনার ঢল,

যখন সে দেখে তার পরানের গহীন শিকড়ে

এমন কঠিন টান আচানক পড়ে সে চঞ্চল?

কিসের সন্ধান করে মানুষের ভিতরে মানুষ?

এমন কি কথা আছে কারো কাছে না কইলে নাই?

সুখের সকল দানা কি কামে যে হইয়া যায় তুষ?

জানি নাই, বুঝি নাই, যমুনারও বুঝি তল নাই।

তয় কি বৃক্ষের কাছে যামু আমি? তাই যাই তয়?

বনের পশুর কাছে জোড়া জোড়া আছে যে গহীনে?

যা পারে জবাব দিতে, গিয়া দেখি শূণ্য তার পাড়া,

একবার নিয়া আসে আকালের কঠিন সময়,

আবার ভাসায় ঢলে খ্যাতমাঠ শুকনার দিনে,

আমার আন্ধার নিয়া দেয় না সে একটাও তারা।



১৫

আমারে সোন্দর তুমি কও নাই কোনো একদিন,

আমার হাতের পিঠা কও নাই কি রকম মিঠা,

সেই তুমি তোমারেই দিছি আমি যুবতীর চিন-

চোখ-কানা দেখ নাই বিছানায় আছে লাল-ছিটা?

তয় কি তোমারে আমি ফাঁকি দিয়া পিছন বাড়িতে

যামু তার কাছে কও আমারে যে দিতে যায় পান?

অথবা জিগার ডালে ফাঁসি নিয়া নিজের শাড়িতে

ভূত হয়া তোমার গামছায় দিমু আন্ধারে টান?

তখন আমারে তুমি দেখি হেলা করো কি রকম,

শরীল পাথর হয়া যায় কি না পানের ছোবলে,

আমারে হারায়া দেখি জমিহারা চাষী হও কি না?

এমন দেখতে বড় সাধ হয় আল্লার কসম,

দেখার বাসনা করে কালপোকা তোমার ফসলে,

অথচ ঘরেই থাকি, পোড়া ঘরে থাকতে পারি না।।



১৬

যমুনার পারে আসলে তার কথা খালি মনে হয়,

এমন পরান পড়ে- সব কিছু বিকাল-বিকাল,

লোকের চেহারা দেখি, হাত নাড়ে, নাড়ে তারা পাও,

কথা কয়, তাও বোঝা যায় না যে কি কয় কি কয়।

চক্ষের ভিতরে নাচে হাটবারে বাঁওহাতি খাল,

নায়ের উপরে দাগ- একদিন রাখছিল পাও।

জলে ভেঁজা, কত বর্ষা গ্রীষ্মকাল গ্যাছে তারপর,

কতবার নাও নিয়া পাড়ি দিছি এ কুল ও কুল,

তাও সেই পাড় আমি চিনি নাই, দেখি নাই গাঙ্গে।

বুকের ভিতরে ঢেলা সারাদিন কিষানেরা ভাঙ্গে,

রাখাল নষ্টামি করে, পড়ে লাল শিমুলের ফুল,

জলের ভিতরে নড়ে মনে বান্ধা আছিল যে ঘরে।

কইছিল সে আমারে- সেই পাড়ে নিবা না আমারে?

কোন পাড়? ইচ্ছা তার আছিল সে যায় কোন পাড়ে?



১৭

এমন অদ্ভুতভাবে কথা কয়া ওঠে কে, আন্ধারে?-

য্যান এক উত্তরের ধলাহাঁস দক্ষিণের টানে

যাইতে যাইতে শ্যাষে শুকনা এক নদীর কিনারে

ডাক দিয়া ওঠে, ‘আগো, চেনা কেউ আছো কোনোখানে?’

আমি তো নিরালা মনে আছিলাম আমার সংসারে,

তার সেই ডাক, সেই কান্দনের আওয়াজটা কানে

যাইতেই দেখি য্যান একা আমি চৈতের পাথারে-

আমারে আমার সব নিদারুণ তীর হয়া হানে।

আমি তা্রে কি দিব উত্তর? তারে কোন কথা কই?

সে ক্যান আমারে ডাক দিয়া গেল, বুঝিনা ইয়াও।

আমি কি করবার পারি? কতটুকু ক্ষমতা আমার?

উপস্থিত মনে হয়, তারে আমি ডাক দিয়া লই,

ঝাপাইয়া ছিনতাই করি যমুনার ছিপছিপা নাও,

সকল ফালায়া দিয়া নিরুদ্দেশ সাথে যাই তার।।



১৮

এ কেমন শব্দ, এ কেমন কথার আদব?

কাতারে কাতার খাড়া, আমি তার ভেদ বুঝি নাই।

নিজের চিন্তার পাখি উড়ায়া যে দিমু কি তাজ্জব,

খানিক হুকুম মানে, তারপর বেবাক নাজাই।

শব্দের ভিতর থিকা মনে হয় শুনি কার স্বর,

একজন, দুইজন, দশজন, হাজার হাজার-

আমার মতন যারা ছিল এই মাটির উপর,

এখন কবরে গ্যাছে, করি আমি তাদেরই বাজার।

এরেই বন্ধন কয়? এর থিকা মুক্তি কারো নাই।

যখনি তোমার ভাষা আমি কই, তুমি ওঠো কয়া,

আমার মূর্তির মুখ আলগোছে বদলায়া দ্যাও।

যদিবা চেতনা পায়া কিছু করি হাতে লাগে ছ্যাও।

আসলে তোমার মতো এতখানি কেউ না নিদয়া,

যার দ্যাশ তার দ্যাশে চলে তার নিজের টাকাই।।



১৯

পথের উপরে এক বাজপড়া তালগাছ খাড়া,

পিছের জঙ্গল থিকা কুড়ালের শব্দ শোনা যায়,

যমুনার জলে দ্যাখে নাও তার নিজের চেহারা,

বাতাসের কোলে মাথা কুশালের ফসল ঘুমায়,

ধুলায় চক্কর দিয়া খেলা করে বিরান পাথার,

তুলার অনেকগুলা ফুল আটকা জিগার আঠায়,

দমের ভিতরে থামা বুকরঙ্গি মাছের কাতার,

আতখা বেবাক য্যান গিয়া পড়ছে অচিনঘাটায়।

আমিও সেবার এক সুনসানে গিয়া পড়ছিলাম-

য্যান সব টান দিয়া নিয়া গ্যাছে সে কার বারুন,

যেইদিকে চাই দেখি ভয়ানক নিঝুম নিথর,

নিয়া গ্যাছে নাম ধাম আর ইচ্ছার নায়ের বাদাম,

অঙ্গের কুসুম নিয়া খেলা করছে দুফর দারুণ,

যেদিন ফালায়া গেল আমারে সে আমার ভিতর।।



২০

কি কামে দুফর বেলা পাতাগুলা উড়ায় বাতাস?

আবার সে কার স্বর মাঠাপাড়ে ফোঁপায় এমন?

কি কামে আমার চক্ষে পড়ে খালি মানুষের লাশ?

যা দ্যাখার দেইখাছি, বাকি আছে আর কি দ্যাখন?

সময় দেখায়া গ্যাছে বাল্যকালে আমের সুঘ্রাণে?

যৈবন অন্যের হাতে য্যান এক কাচের বাসন,

দুঃখের পাখিরে আমি দেইখাছি বিয়ার বিহানে,

কিভাবে কালির লেখা হয়া যায় জলের লিখন।

আমারে ছাড়ান দিয়া যায় না সে যেখানেই যাই,

দ্যাশ কি বিদ্যাশ কও, চিনা কিংবা অচিনাই হও,

দুঃখের বাদাম তোলা সেই এক নাও সব গাঙ্গে।

পালায়া নিস্তার কই? সবখানে সেই না শানাই।

যেইখানেই যাই গিয়া, খাড়া দেখি সেই শও শও

পুয়ারন মিস্তিরি- তারা মনোযোগ দিয়া সব ভাঙ্গে।।



২১

হাজার দক্ষিণ দিকে যাও তুমি গাঙ্গের মোহানা

পাও যদি কইও আমারে। আমি না অনেক দিন

আমার যৈবন আমি মোহানার খোঁজে না দিলাম,

তাও তারে দেখি নাই, শুনি আছে ধলা গাঙচিল,

মাছের পাহারা ঘেরা খিজিরের অতল আস্তানা,

আছে তার ইশারায় আগুনের দেহ এক জ্বীন-

যদি ইচ্ছা করে তার অসম্ভব নাই কোন কাম,

যারে না পাইতে পারি তারো সাথে দিতে পারে মিল।

তুমি যে মনের মতো ঘরে আছো এই কথা কও-

সেই ভাগ্য মনে হয় খিজিরের বিশেষ অছিলা।

আমার হিসাবে কয়- মানুষের সাধ্য নাই পায়।

যতই সাধনা কর, পরানের যত কাছে রও

সে জন দুরেই থাকে, তুমি থাকো যেখানে আছিলা।

আমার জানতে সাধ, মোহানায় গ্যাছে কোন নায়।।



২২

এক্কেরে আওয়াজ নাই, নদী খালি চাপড় দিতাছে

গেরামের পিঠে আর ফিসফাস কইতাছে, ‘ঘুম,

ঘুমারে এখনতরি সাতভাই পূর্বদিকে আছে।‘

এক ফোঁটা ঘুম যে আসে না তার আমি কি করুম?

অখনো খেজুরগাছে টুপটুপ রস পড়তে আছে,

এত যে কান্দন আছে- তয় চক্ষু ভেজে না কেমন?

ঘাটের যুগল নাও য্যান ঠোঁটে ঠোঁট দিয়া আছে,

আমার দক্ষিণ পাশে সরে নাই চান্দের গেরন।

আধান শীতলপাটি ভরা এক আমাবস্যা নিয়া

দেখি রোজ উত্তরের একদল ধলাহাঁস নামে,

বুকের ভিতরে চুপ, তারপর আতখা উড়াল-

এ দ্যাশে মানুষ নাই, অন্যখানে তাই যায় গিয়া।

এখানে কিসের বাড়ি? এত দ্রব্য আসে কোন কামে?

কেউ না দেখুক, তারা দেইখাছে দুঃখের কুড়াল।।



২৩

আমারে যেদিন তুমি ডাক দিলা তোমার ভাষায়

মনে হইল এ কোন পাখির দ্যাশে গিয়া পড়লাম,

এ কোন নদীর বুকে এতগুলা নায়ের বাদাম,

এত যে অচিন বৃক্ষ এতদিন আছিল কোথায়?

আমার সর্বাঙ্গে দেখি পাখিদের রাতির পালক,

নায়ের ভিতর থিকা ডাক দ্যায় আমারে ভুবন,

আমার শরীলে য্যান শুরু হয় বৃক্ষের রোপণ,

আসলে ভাষাই হইল একমাত্র ভাবের পালক।

তাই আমি অন্যখানে বহুদিন ছিলাম যদিও,

যেদিন আমারে তুমি ডাক দিলা নিরালা দুফর,

চক্ষের পলকে গেল পালটায়া পুরানা সে ঘর,

তার সাথে এতকাল আছিল যে ভাবের সাথীও।

এখন আমার ঠোঁটে শুনি আমি অন্য এক স্বর,

ভাষাই আপন করে আর সেই ভাষা করে পর।।



২৪

আবার তোমার কোলে ফিরা যায় তোমার সন্তান,

আবার তোমার কোলে, খালি কোল, উথলায়া পড়ে

দুধের ঘেরানে ভরা, জননী গো, পুন্নিমার চান-

আবার সে ঘরে ফিরা আইসাছে সারাদিন পরে।

আবার সে আইসাছে করালের ঘুম চক্ষে নিয়া,

চক্ষের ভিতরে তার গেরেপ্তার বিহানের সোনা,

তবনের নীল খোপে শিমুলের লাল রঙ নিয়া,

আবার সে আইসাছে, জননী গো, তুমি কাইন্দো না।

তোমার সন্তান গ্যাছে জননী গো, সে আমার না ভাই,

আমার দেহের থিকা একখানা কাটা গ্যাছে হাত,

উঠানে খাড়ায়া আছি, খুলবা না তোমার দুয়ার?

আমার মতন যারা হারায়াছে আইজ তার ভাই,

য্যান শিলাবিষ্টি শ্যাষে পরিস্কার আকাশ হঠাৎ ,

হাজার হাজার তারা ঘিরা আছে পুন্নিমা তোমার।।



২৫

কত না দুধের ক্ষীর খায়া গ্যাছে কালের গোপাল,

কতবার কত রোয়া কারবালা খ্যাতের খরায়,

কন না রঙিলা নাও নিয়া গ্যাছে কাল যমুনায়,

অঘোরে হারায়া গাভি ফেরে নাই নিজস্ব রাখাল।

কত না পুকুর দিতে পারে নাই পানি গ্রীষ্মকালে,

বাসকের ছাল কত ভালো করতে পারে নাই রোগ,

দেহের কত না রক্ত খায়া গ্যাছে কত ছিনাজোঁক,

কুসুম উধাও হয়া গ্যাছে কত শিমুলের ডালে।

তাই কি ছাড়ান দিমু বিহানের ধবল দোহান?

কামারের কাছে বান্ধা দিমু এই রূপার লাঙ্গল?

আমার বৃক্ষেরে তাই দিতে কমু জহরের ফল?

বাদ দিয়া দিমু কও পরানের গহীন কথন?

আমার তিস্তারে দেখি, সেও পোষ মানে না ভাটিতে,

কি তার উথাল নাচ গেরস্তের সমান মাটিতে!



২৬

ক্যান তুই গিয়াছিলি?- আমি তরে জিগামু অখন

চান্দের ভিতর ফের, যেইখানে জটিলতা বাড়ে,

অশথ জড়ায়া থাকে নদী নিয়া জলের কিনারে,

আমার গেরাম ঘিরা যেইখানে খালি পলায়ন-

মানুষের, মানুষের, আর তর চক্ষের কাজল,

যেইখানে মেলা দেয় একখান সুনসান নাও,

যে নায়ে সোয়ার নাই, ‘কেডা যাও, কেডা বায়া যাও?’

বেকল আছাড় দিয়া ওঠে কালা যমুনার জল?

কেউ নাই, কেউ তর নাই, তুই নিজেই জানস,

তবু ক্যান গিয়াছিলি? ক্যান তুই দিয়াছিলি ফাল?

কিসের কি বাদ্যে তর রক্ত করে উথাল পাথাল

আমারে ক’ দেখি তুই? ক’না দেখি, কি চিল মানস?

ল’যাই জলের ধারে দ্যাখ ছায়া আমার কি তর?

মানুষে মানুষে নাই কোনো ভেদ দুঃখের ভিতর।।



২৭

আউসের খ্যাতে মাঠে যুবতীরা দিতাছে সাঁতার,

দ্যাখো না কেমন তারা চিতলের মতো খেলা করে,

কি তারা তালাশ করে দিনমান নাগর ভাতার-

যারা ডুব দিয়া আছে এই ধান বানের সাগরে;

বিছনের মতো পড়ে তারাবাজি চুমার চুমার,

কি ঘাই আতখা মারে খলবল এই হাসে তারা

একজন দুইজন সাতজন নাকি বেশুমার

বুকের ভিতরে ভাঙ্গে নিশীথের শরমের পাড়া।

আমি যেই সেইখানে আচানক গিয়া পড়লাম

চক্ষের নিমেষে তারা নাই আর কোনোখানে নাই,

আমি যেই সেইখানে তোমারেনি খোঁজ করলাম-

কিছু না দেইখা নিজে বেয়াকুফ বড় শরমাই।

এই ছিল এই নাই, কই গেল, কই যার তারা?

বেমালুম কই তুমি যাও গিয়া খা’বের ইশারা?



২৮

ঝকঝক ঝকঝক সারাদিন করে আয়নাটা-

বুকে নাই ছবি নাই পড়ে নাই একখানা ছবি,

বেবাক একাকী য্যান সুনসান ইস্কুরুপে আঁটা,

যা চাই তা নাই তয় চমৎকার আছে আর সবি।

আছে সবি আছে এক মইষের শিঙ্গের চিরুনি,

রুমাল, চুলের ফিতা জবজবা এখনোনি ত্যালে।

বিবাহের বাসরে শ্যাষ য্যান গেছে সে ফিরুনি-

ফেরার আশাও নাই, ফেরা নাই একবার গ্যালে।

গেছে তো আমারে যদি বেরহম নিয়া যায় সাথে,

আমি তো এমন ঘরে বাস করি আশা করি নাই;

য্যান হাত দিয়া আছি ইন্দুরের বিষআলা ভাতে,

তবু তো ধরে না বিষ মুখে তুলি যত লোকমাই।

নিজেরও পড়ে না ছবিকাটা সেই আয়নায়,

সে নাই চেহারা নাই, খালি বড় খালি তড়পায়।।



২৯

তোমারে যে ভালোবাসে এর থিকা আরো পাঁচগুন

আল্লার কসম আমি দিমু তারে এই জামাখান,

আমার কলম আমি দিমু তারে, শরীলের খুন

দোয়াত ভরায়া দিমু, অনুরোধ খালি একখান-

সে য্যান আমার থিকা আরো ভালো পদ্য লেখে আর

যাদুমন্ত্রে রূপার শিকল হাতে দিতে পারে তার।

তোমারে যে ভালোবাসে এর থিকা আরো দশগুন

আল্লার কসম আমি দিমু তারে এই বাড়িখান,

আমার উঠান আমি দিমু তারে, শীতের আগুন-

নিজেই সাজায়া দিমু, অনুরোধ খালি একখান-

সে য্যান আমার থিকা আরো ভালো নিদ্রা যায় আর

তারেই নিকটে পায় কথা যার নিকটে থাকার।

নচেৎ নষ্টামি জানি, যদি পাছ না ছাড়ে আমার,

গাঙ্গেতে চুবান দিয়া তারে আমি শুকাবো আবার।।



৩০

আরে ও ইসের বেটি, চুলে দিয়া শিমুলের ফুল

যাস কই, কই যাস? যুবকের মাঝখান দিয়া?

মানুষ গাঙ্গের মতো, বানে ভাসে তারো দুই কুল-

সে পানি কাতান বড়, খলবল রঙ তার সিয়া।

আরে থাম, কই যাস? তবু যায় ঘুরনান দিয়া?

শিমুল যতই লাল সেই লাল তবু কিছু কম

যত লাল যেইখানে দেহ তর লুকায় শরম।

খাড়া না করুক দেখি একবার কেউ তরে বিয়া।

বেবাক পানির টান সেইকালে নরোম সোঁতায়,

তখন পরীর রানী সেও কিনা অতি বাধ্য বশ,

তখন দেখিনা তুই আইলের বেড়া নি ভাঙ্গস,

তখন শরম দেখি থাকে তর কেমন কোথায়?

নষ্ট তর পায়ে পায়ে স্বন্নলতা আনন্তের মূল,

দিবিনে তখন তুই সিঙ্গারের আসল মাশুল।।



৩১

কে করে পরশ তার জীবনের এত জটিলতা?

তোমার অধিক টান দেয় বৃক্ষ দেয় বিষলতা;

একবার আমারে আছাড় দিয়া সোজা করে ফের,

আমারই মতন যারা বেশুমার সন্তান মায়ের।

কিসে যে চালনা করে এই দেহ এই ভবিষ্যৎ-

কিছুই বুঝি না, দেখি আচানক শেষ হয় পথ;

যে পথেই মেলা দেই সেই পথে ভয়ানক ভুত-

এ বড় কঠিন জাগা, বসবাস বড়ই অদ্ভুত।

তয় কি ছাড়ান দিমু হাতে ধরা শেষ রশিখান?

তয় কি পাথারে দিমু হাতে ধরা বেঘোরে পরান?

নাকি তুমি একবার হাত দিয়া ডাক দিবা কাছে

আমারেও আমার মতন যারা একা একা আছে,

সকলেরে একজোট কইরা নি তুলবা আবার?

তোমার নিকটে রাখি নিদানের এই দরবার।।



৩২

নিঝুম জঙ্গল দিয়া যাইতেই ধনেশের ডাক।

যেমন আতখা ভাঙ্গে কাঠুরার বুকের কাছাড়

চক্ষের পলকে তুমি দেখা দিয়া করো মেছমার;

রতির আগুনে সব দাউদাউ, পরিণামে খাক

আমার এ দেহ বটে, ভবিষ্যৎ পায় না নিস্তার;

সকল কিছুর পরে দ্যাও তুমি উড়ায়া বাদাম,

তীরের মতন তারা ধায়া যায় কও কোন ধাম?

বরং তোমার থিকা দয়াবতী জোয়ার নিস্তার।

তবুও আবার আমি ধনেশের মতো দিয়া ডাক

আবার পাথার বন পথ ঘাট বাজার সংসার

তালাশ করুম আর গাভীনের করুম সন্ধান,

আবার দেখুম আমি ছাই-পোকা মাজরার ঝাঁক

কিভাবে আমার খ্যাত করে সব শস্য ছারখার,

আবারো বুনুম আমি এই খ্যাতে কাউনের ধান।।



৩৩

এমন বৃক্ষ কি নাই ডালে যার নাই কোন পরী,

এমন নদী কি নাই জলে যার পড়ে না চেহারা,

এমন যাত্রা কি নাই যাতে নাই পবনের তরী,

এমন ডুলি কি নাই যাতে নাই নিষেধের ঘেরা,

এমন নারী কি নাই বুকে যার নাই ভালোবাসা,

এমন পত্র কি নাই বাক্যে যার নাই নিরাময়,

এমন শস্য কি নাই যার বীজ বোনে নাই চাষা,

এমন মৃত্যু কি নাই যাতে নাই খোয়াবের লয়?

এমন কি রূপ আছে রূপ যার গড়ে না কুমার,

এমন কি দেখা আছে দেখা যার চোখে না কুলায়,

এমন কি কথা আছে কথা যার থাকে না ধুলায়,

এমন কি নেশা আছে নেশা যার অধিক চুমার?

পরানে পরান যদি এই মতো হাজার সোয়াল

সারাদিন যমুনায় খলবল বিতল বোয়াল।।

হাত বাড়ালে বল্‌বি হেসে আমি তো তোর নই - সৈয়দ নূর কামাল

চল্‌না আবার দু’জন মিলে আগের মতো হই
হৃদয় ভরা দুঃখ সুখের গল্প কথা ক’ই

বাড়ির পাশের কুলের বনে, বসে দু’জন নিরজনে
গোপন যতো মনের কথা চোখের ভাষায় ক’ই

জড়িয়ে ধরে বুকের ভেতর, করতে যখন চাইব আদর
বলিস রেগে আমি যেনো সীমার মাঝে রই

ভ্রমর কালো দীঘল চুলে, বাঁধ্‌বি বেণি শিউলি ফুলে
হাত বাড়ালে বল্‌বি হেসে আমি তো তোর নই

টস্‌টসে লাল অধর পরে, চুম্‌তে গেলে জড়িয়ে ধরে
বল্‌বি ফুঁসে এই ফাজিলের কেম্‌নে জ্বালা স’ই

থাকলে দু’দিন কোনখানে, ঠোঁট ফোলাবি অভিমানে
কইলে কিছু বল্‌বি রেগে "আমি কে তোর হই

চল্‌না আবার দু’জন মিলে আগের মতো হই
হৃদয় ভরা দুঃখ সুখের গল্প কথা কই

কী করলি? - শর্মিষ্ঠা ঘোষ

ঐ ছেলে, তুই করলি টা কী?
মরা ডালে হাত ছোঁয়ালি?
এখন আমার কাঁপছে মাটি শেকড় তলে
কাঁপছে আমার ভূবন জুড়ে মরণ বাঁচন ছন্দ সকল
তিরতিরানি চরা স্রোতের ঝরনা নামে বুকের তলে।

ঐ ছেলে, তোর ধরণ কেমন?
তরুণ যুবক ঝরের মাতন
ঝরা পাতার তরাস জাগাস
আমার এমন সাঁঝ বেলাতে?
সমুদ্দুরের ডাক পাঠালি,
ভাঁটির গাঙে উজান এল
মরা নদীর কুল ছাপিয়ে ভাসিয়ে দিলই মিথ্যে বাঁচন
চোখে কি তোর ঘোর লেগেছে?
চুলের ঢলে বাড়ছে বয়েস
ত্বকের সকল বলিরেখা অভিজ্ঞতার গল্প বলে
রক্তে শুনি শীতল শীতল সরীসৃপের শিরশিরানি
দৃষ্টি মেলি এখন আমি হিমবাহের ওপার থেকে
শেষ বেলাতে হৃদয় হরণ কেন আকুল উল্টো টানিস?
উঠলো তলে স্থিতধী মন,
পায়ের মাটি অনিশ্চিত।

তুহু মম শ্যামসমান - রেজা রহমান

এক

আসেনা আসেনা ঘুম
যদি বা আসেই সে ভেঙে যায়
কে তাকে রোখে কে ফেরায়!
ভেঙে যাবে কাঁচ তো নয় ঝনঝন
না কেউ শোনে বা না দেখে ভাঙন।

ছবি নেই দেখি
গান নেই শুনি
পল গুনি কি মুহূর্ত গুনি
জানিনে জানিনে সে তো নিজে
যত বুজতে চাই চোখ
তত আসে ভিজে।

কাউকে কি ছোঁবে এই ছবি
দু’পঙক্তি কি লিখবে কোন কবি
কেউ কি গাইবে একটা গান
মরণ রে তুহু মম শ্যামসমান?
কথা ছিল বলা যায়
শুনবেটা কে!
এ-ঘরে সবাক প্রাণী একটাই থাকে।
বাকি যারা আরশোলা ইঁদুর

হরপ্পা মহেঞ্জোদারো থেকে আর দূর
কোথাও কি জেগে আছে আর কেউ
এই আমার মত
কাঁটা ছেঁড়া পোড়া খুব ক্ষত বিক্ষত
নিতে পারে যে আমার কল
যুক্ত হয়ে গড়া যায়
মুক্তশক্তি ঐক্য অবিচল?

গড়ে কি তোলা যায় সিদ্ধবাক
অলৌকিক খেয়া
কুহকিনী নিশীথিনী উত্তাল
সমুদ্র পাড়ি দেয়া
রাতভোরে আলোকণা চিকচিক
বালুকাবেলায়
যেখানে আঁধার মেলে চোখ
বুজে আলোর মেলায়?
সারাদিনমান
দুইভাগ জল আর একভাগ
ডাঙায় শয়ান
শান্তিঘুম নেমে আসে নীলাকাশ থেকে
পরাপাখি তুইও ঘুমো প্রাণ।

এক শিশি চোখের জল এবং ... - আনিসুল হক

আমি প্রতিমাসে এক শিশি চোখের জল কিনি
এর নাম রিফ্রেশ টিয়ার
মেডইন টেক্সাস ইউএসএ

আমার ডাক্তার এই ড্রপারটা সর্বদা পকেটে রাখতে বলেছেন
যখনই আমার কাঁদতে ইচ্ছা করে
আমি যেন সেটা ইউজ করতে পারি

সেদিন ওষুধের দোকানে গিয়ে
আমি এক শিশি রিফ্রেশ লাফটার চাইলাম

এই ওষুধের দোকানি আমার সব খবর রাখেন

আমার হার্টের খবর
আমার ব্লাড প্রেসারের খবর
এমনকি মাসে আমার কতগুলো নিরোধক লাগে
আমি চোখের জল কিনি তিনি জানেন
আমি মুখের হাসি কিনতে চাই শুনে তিনি হাসলেন

আমি তার মুখের হাসিটা কিনতে পারলাম না
ওটা বাজারজাত করার কথা যখন ভাবছি

তখনই দেখি ওটা পেটেন্ট করা হয়ে গেছে ...

জলহাওয়ার লেখা - জয় গোস্বামী

স্নেহসবুজ দিন
তোমার কাছে ঋণ

বৃষ্টিভেজা ভোর
মুখ দেখেছি তোর

মুখের পাশে আলো
ও মেয়ে তুই ভালো

আলোর পাশে আকাশ
আমার দিকে তাকা–

তাকাই যদি চোখ
একটি দীঘি হোক

যে-দীঘি জ্যো‌ৎস্নায়
হরিণ হয়ে যায়

হরিণদের কথা
জানুক নীরবতা–

নীরব কোথায় থাকে
জলের বাঁকে বাঁকে

জলের দোষ? — নাতো!
হাওয়ায় হাত পাতো!

হাওয়ার খেলা? সেকি!
মাটির থেকে দেখি!

মাটিরই গুণ? — হবে!
কাছে আসুক তবে!

কাছে কোথায়? — দূর!
নদী সমুদ্দুর

সমুদ্র তো নোনা
ছুঁয়েও দেখবো না

ছুঁতে পারিস নদী–
শুকিয়ে যায় যদি?

শুকিয়ে গেলে বালি
বালিতে জল ঢালি

সেই জলের ধারা
ভাসিয়ে নেবে পাড়া

পাড়ার পরে গ্রাম
বেড়াতে গেছিলাম

গ্রামের কাছে কাছে
নদীই শুইয়ে আছে

নদীর নিচে সোনা
ঝিকোয় বালুকণা

সোনা খুঁজতে এসে
ডুবে মরবি শেষে

বেশ, ডুবিয়ে দিক
ভেসে উঠবো ঠিক

ভেসে কোথায় যাবো?
নতুন ডানা পাবো

নামটি দেবো তার
সোনার ধান, আর

বলবোঃ শোন, এই
কষ্ট দিতে নেই

আছে নতুন হাওয়া
তোমার কাছে যাওয়া

আরো সহজ হবে
কত সহজ হবে

ভালোবাসবে তবে? বলো
কবে ভালোবাসবে?

আসমানী প্রেম - নির্মলেন্দু গুণ

নেই তবু যা আছের মতো দেখায়
আমরা তাকে আকাশ বলে ডাকি,
সেই আকাশে যাহারা নাম লেখায়
তাদের ভাগ্যে অনিবার্য ফাঁকি !

জেনেও ভালোবেসেছিলাম তারে ,
ধৈর্য ধরে বিরহ ভার স'বো ;
দিনের আলোয় দেখাবো নিষ্প্রভ
জ্বলবো বলে রাতের অন্ধকারে ।

আমায় তুমি যতোই ঠেলো দূরে
মহাকাশের নিয়ম কোথায় যাবে ?
আমি ফিরে আসবো ঘুরে ঘুরে
গ্রহ হলে উপগ্রহে পাবে !

মাটি হলে পাবে শস্য- বীজে
বাতাস হলে পাবে আমায় ঝড়ে !
মৃত্যু হলে বুঝবে আমি কি যে ,
ছিলেম তোমার সারাজীবন ধরে !

কথোপকথন -৪ - পুর্ণেন্দু পত্রী

- যে কোন একটা ফুলের নাম বল।
- দুঃখ ।
- যে কোন একটা নদীর নাম বল।
- বেদনা ।
- যে কোন একটা গাছের নাম বল।
- দীর্ঘশ্বাস ।
- যে কোন একটা নক্ষত্রের নাম বল।
- অশ্রু ।
- এবার আমি তোমার ভবিষ্যত বলে দিতে পারি ।
- বলো ।
- খুব সুখী হবে জীবনে ।
শ্বেত পাথরে পা ।
সোনার পালঙ্কে গা ।
এগুতে সাতমহল
পিছোতে সাতমহল ।
ঝর্ণার জলে স্নান
ফোয়ারার জলে কুলকুচি ।
তুমি বলবে, সাজবো ।
বাগানে মালিণীরা গাঁথবে মালা
ঘরে দাসিরা বাটবে চন্দন ।
তুমি বলবে, ঘুমবো ।
অমনি গাছে গাছে পাখোয়াজ তানপুরা,
অমনি জোৎস্নার ভিতরে এক লক্ষ নর্তকী ।
সুখের নাগর দোলায় এইভাবে অনেকদিন ।
তারপর
বুকের ডান পাঁজরে গর্ত খুঁড়ে খুঁড়ে
রক্তের রাঙ্গা মাটির পথে সুড়ঙ্গ কেটে কেটে
একটা সাপ
পায়ে বালুচরীর নকশা
নদীর বুকে ঝুঁকে-পড়া লাল গোধূলি তার চোখ
বিয়েবাড়ির ব্যাকুল নহবত তার হাসি,
দাঁতে মুক্তোর দানার মত বিষ,
পাকে পাকে জড়িয়ে ধরবে তোমাকে
যেন বটের শিকড়
মাটিকে ভেদ করে যার আলিঙ্গন ।
ধীরে ধীরে তোমার সমস্ত হাসির রঙ হলুদ
ধীরে ধীরে তোমার সমস্ত গয়নায় শ্যাওলা
ধীরে ধীরে তোমার মখমল বিছানা
ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে, ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিতে সাদা ।
- সেই সাপটা বুঝি তুমি ?
- না ।
- তবে ?
- স্মৃতি ।
বাসর ঘরে ঢুকার সময় যাকে ফেলে এসেছিলে
পোড়া ধুপের পাশে ।

বুধবার, ২ এপ্রিল, ২০১৪

মনে থাকবে? - আরণ্যক বসু

পরের জন্মে বয়স যখন ষোলোই সঠিক
আমরা তখন প্রেমে পড়বো
মনে থাকবে?
বুকের মধ্যে মস্ত বড় ছাদ থাকবে
শীতলপাটি বিছিয়ে দেব;
সন্ধে হলে বসবো দু'জন।
একটা দুটো খসবে তারা
হঠাৎ তোমার চোখের পাতায় তারার চোখের জল গড়াবে,
কান্ত কবির গান গাইবে
তখন আমি চুপটি ক'রে দু'চোখ ভ'রে থাকবো চেয়ে...
মনে থাকবে?
এই জন্মের দূরত্বটা পরের জন্মে চুকিয়ে দেব
এই জন্মের চুলের গন্ধ পরের জন্মে থাকে যেন
এই জন্মের মাতাল চাওয়া পরের জন্মে থাকে যেন
মনে থাকবে?
আমি হবো উড়নচন্ডি
এবং খানিক উস্কোখুস্কো
এই জন্মের পারিপাট্য সবার আগে ঘুচিয়ে দেব
তুমি কাঁদলে গভীর সুখে
এক নিমেষে সবটুকু জল শুষে নেব
মনে থাকবে?
পরের জন্মে কবি হবো
তোমায় নিয়ে হাজারখানেক গান বাঁধবো।
তোমার অমন ওষ্ঠ নিয়ে,
নাকছাবি আর নূপুর নিয়ে
গান বানিয়ে__
মেলায় মেলায় বাউল হয়ে ঘুরে বেড়াবো...
মনে থাকবে?
আর যা কিছু হই বা না হই
পরের জন্মে তিতাস হবো
দোল মঞ্চের আবীর হবো
শিউলিতলার দুর্বো হবো
শরৎকালের আকাশ দেখার__
অনন্তনীল সকাল হবো;
এসব কিছু হই বা না হই
তোমার প্রথম পুরুষ হবো
মনে থাকবে?
পরের জন্মে তুমিও হবে
নীল পাহাড়ের পাগলা-ঝোরা
গায়ের পোষাক ছুড়ে ফেলে
তৃপ্ত আমার অবগাহন।
সারা শরীর ভ'রে তোমার হীরকচূর্ণ ভালোবাসা।
তোমার জলধারা আমার অহংকারকে ছিনিয়ে নিল।
আমার অনেক কথা ছিল
এ জন্মে তা যায়না বলা
বুকে অনেক শব্দ ছিল__
সাজিয়ে গুছিয়ে তবুও ঠিক
কাব্য করে বলা গেল না!
এ জন্ম তো কেটেই গেল অসম্ভবের অসঙ্গতে
পরের জন্মে মানুষ হবো
তোমার ভালোবাসা পেলে
মানুষ হবোই মিলিয়ে নিও!

শুক্রবার, ১৪ মার্চ, ২০১৪

ঘর - রুদ্র গোস্বামী


মেয়েটা পাখি হতে চাইল
আমি বুকের বাঁদিকে আকাশ পেতে দিলাম।

দু-চার দিন ইচ্ছে মতো ওড়াওড়ি করে বলল,
তার একটা গাছ চাই।

মাটিতে পা পুঁতে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম।
এ ডাল সে ডাল ঘুরে ঘুরে ,
সে আমাকে শোনালো অরণ্য বিষাদ।

তারপর টানতে টানতে
একটা পাহাড়ি ঝর্ণার কাছে নিয়ে এসে বলল,
তারও এমন একটা পাহাড় ছিল।
সেও কখনো পাহারের জন্য নদী হোতো।

আমি ঝর্ণার দিকে তাকিয়ে মেয়েটিকে বললাম,
নদী আর নারীর বয়ে যাওয়ায় কোনও পাপ থাকে না।

সে কিছু ফুটে থাকা ফুলের দিকে দেখিয়ে
জানতে চাইল,
কি নাম ?
বললাম গোলাপ।

দুটি তরুণ তরুণীকে দেখিয়ে বলল,
কি নাম ?
বললাম প্রেম।

তারপর একটা ছাউনির দিকে দেখিয়ে
জিজ্ঞেস করলো,
কি নাম ?
বললাম ঘর।

এবার সে আমাকে বলল,
তুমি সকাল হতে জানো ?
আমি বুকের বাঁদিকে তাকে সূর্য দেখালাম ।

বুধবার, ১২ মার্চ, ২০১৪

জন্মই আমার আজন্ম পাপ - দাউদ হায়দার

জন্মই আমার আজন্ম পাপ, মাতৃজরায়ু থেকে নেমেই জেনেছি আমি
সন্ত্রাসের ঝাঁঝালো দিনে বিবর্ণ পত্রের মত হঠাৎ ফুৎকারে উড়ে যাই
পালাই পালাই সুদূরে

চৌদিকে রৌদ্রের ঝলক
বাসের দোতলায় ফুটপাতে রুটির দোকানে দ্রুতগামী
নতুন মডেলের
চকচকে বনেটে রাত্রির জমকালো আলো
ভাংগাচোরা চেহারার হদিস

ক্লান্ত নিঃশব্দে আমি হেঁটে যাই
পিছনে ঝাঁকড়া চুলওয়ালা যুবক। অষ্টাদশ বর্ষীয়ার নিপুণ ভঙ্গী
দম্পতির অলৌকিক হাসি প্রগাঢ় চুম্বন

আমি দেখে যাই, হেঁটে যাই, কোথাও সামান্য বাতাসে উড়ে যাওয়া চাল-
অর্থাৎ আমার নিবাস।

ঘরের স্যাঁতসেতে মেঝেয় চাঁদের আলো এসে খেলা করে
আমি তখন সঙ্গমে ব্যর্থ, স্ত্রীর দুঃখ অভিমান কান্না
সন্তান সন্তুতি পঙ্গু
পেটে জ্বালা, পাজরায় তেল মালিশের বাসন উধাও-
আমি কোথা যাই? পান্তায় নুনের অভাব।

নিঃসংগতাও দেখেছি আমি, উৎকন্ঠার দিনমান জ্বলজ্বলে বাল্বের মতোন
আমার চোখের মতো স্বজনের চোখ-
যেন আমুন্ড গ্রাস করবে এই আমাকেই
আমিই সমস্ত আহার নষ্ট করেছি নিমেষে।

শত্রুর দেখা নেই, অথচ আমারি শত্রু আমি-
জ্বলন্ত যৌবনে ছুটি ফ্যামিলি প্ল্যানিং কোথায়
কোথায় ডাক্তার কম্পাউন্ডার
যারা আমাকে অপারেশন করবে?

পুরুষত্ব বিলিয়ে ভাবি, কুড়ি টাকায় একসের চাল ও অন্যান্য
সামান্য দ্রব্যাদী মিলবে তো?
আমার চৌদিকে উৎসুক নয়ন আহ্লাদী হাসি
ঘৃণা আমি পাপী
এরা কেন জন্ম নেয়?
এরাই তো আমাদের সুখের বাধা অভিশাপ।
মরণ এসে নিয়ে যাক, নিয়ে যাক
লোকালয়ের কিসের ঠাঁই এই শত্রুর?
-বলে
প্রাসাদ প্রেমিকেরা

আমিও ভাবি তাই, ভাবি নতুন মডেলের চাকায় পিষ্ট হবো
আমার জন্যই তোমাদের এত দুঃখ
আহা দুঃখ
দুঃখরে!

আমিই পাপী, বুঝি তাই এ জন্মই আমার আজন্ম পাপ।

শুক্রবার, ৭ মার্চ, ২০১৪

স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো - নির্মলেন্দু গুণ

একটি কবিতা লেখা হবে, তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে
লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে
ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে: ‘কখন আসবে কবি?’

এই শিশু-পার্ক সেদিন ছিল না,
এই বৃক্ষে ফুলে শোভিত উদ্যান সেদিন ছিল না,
এই তন্দ্রাচ্ছন্ন বিবর্ণ বিকেল সেদিন ছিল না।
তা হলে কেমন ছিল সেদিনের সেই বিকেল বেলাটি?
তা হলে কেমন ছিল শিশু-পার্কে, বেঞ্চে, বৃক্ষে,
ফুলের বাগানে ঢেকে দেয়া এই ঢাকার হূদয় মাঠখানি?

জানি, সেদিনের সব স্মৃতি মুছে দিতে হয়েছে উদ্যত
কালো হাত। তাই দেখি কবিহীন এই বিমুখ প্রান্তরে আজ
কবির বিরুদ্ধে কবি,
মাঠের বিরুদ্ধে মাঠ,
বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল,
উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান,
মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ...।

হে অনাগত শিশু, হে আগামী দিনের কবি,
শিশু-পার্কের রঙিন দোলনায় দোল খেতে খেতে তুমি
একদিন সব জানতে পারবে; আমি তোমাদের কথা ভেবে
লিখে রেখে যাচ্ছি সেই শ্রেষ্ঠ বিকেলের গল্প।
সেদিন এই উদ্যানের রূপ ছিল ভিন্নতর।
না পার্ক না ফুলের বাগান, ...এসবের কিছুই ছিল না,
শুধু একখণ্ড আকাশ যে রকম, সে রকম দিগন্তপ্লাবিত
ধু-ধু মাঠ ছিল দুর্বাদলে ঢাকা, সবুজের সবুজময়।
আমাদের স্বাধীনতাপ্রিয় প্রাণের সবুজ এসে মিশেছিল
এই ধু-ধু মাঠের সবুজে।

কপালে, কবজিতে লালসালু বেঁধে
এই মাঠে ছুটে এসেছিল কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক,
লাঙল জোয়াল কাঁধে এসেছিল ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক;
পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে এসেছিল প্রদীপ্ত যুবক।
হাতের মুঠোয় মৃত্যু, চোখে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল মধ্যবিত্ত,
নিম্ন মধ্যবিত্ত, করুণ কেরানী, নারী, বৃদ্ধ, বেশ্যা, ভবঘুরে
আর তোমাদের মতো শিশু পাতা-কুড়ানীরা দল বেঁধে।
একটি কবিতা পড়া হবে, তার জন্য কী ব্যাকুল
প্রতীক্ষা মানুষের: ‘কখন আসবে কবি?’
‘কখন আসবে কবি?’
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন।

তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হূদয়ে লাগিল দোলা,
জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার সকল দুয়ার খোলা।
কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর
অমর কবিতাখানি:
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।

বুধবার, ৫ মার্চ, ২০১৪

বসন্ত বন্দনা - নির্মলেন্দু গুণ


হয়তো ফুটেনি ফুল রবীন্দ্র-সঙ্গীতে যতো আছে,

হয়তো গাহেনি পাখি অন্তর উদাস করা সুরে

বনের কুসুমগুলি ঘিরে। আকাশে মেলিয়া আঁখি

তবুও ফুটেছে জবা, দূরন্ত শিমুল গাছে গাছে,

তার তলে ভালোবেসে বসে আছে বসন্ত-পথিক।



এলিয়ে পড়েছে হাওয়া, ত্বকে কী চঞ্চল শিহরণ!

মন যেন দুপুরের ঘূর্ণি-পাওয়া পাতা, ভালোবেসে

অনন্ত সঙ্গীত স্রোতে পাক খেয়ে মৃত্তিকার বুকে

নিমজ্জিত হতে চায়। হায় কী আনন্দ জাগানিয়া।



এমন আগ্রাসী ঋতু থেকে যতোই ফেরাই চোখ,

যতোই এড়াতে চাই তাকে দেখি সে অনতিক্রম্য।

বসন্ত কবির মতো রচে তার রম্য কাব্য খানি

নবীন পল্লবে, ফুলে-ফুলে। বুঝি আমাকেও শেষে

গিলেছে এ খল-নারী আপাদমস্তক ভালোবেসে।



আমি তাই লঘুচালে বন্দিলাম স্বরূপ তাহার,

সহজ অক্ষরবৃত্তে বাঙলার বসন্ত বাহার।


সোমবার, ৩ মার্চ, ২০১৪

যে টেলিফোন আসার কথা - পূর্ণেন্দু পত্রী

যে টেলিফোন আসার কথা সে টেলিফোন আসেনি।
প্রতীক্ষাতে প্রতীক্ষাতে
সূর্য ডোবে রক্তপাতে
সব নিভিয়ে একলা আকাশ নিজের শূন্য বিছানাতে।
একান্তে যার হাসির কথা হাসেনি।
যে টেলিফোন আসার কথা আসেনি।

অপেক্ষমান বুকের ভিতর কাঁসরঘন্টা শাখেঁর উলু
একশ বনের বাতাস এসে একটা গাছে হুলুস্থুলু
আজ বুঝি তার ইচ্ছে আছে
ডাকবে আলিঙ্গনের কাছে
দীঘির পাড়ে হারিয়ে যেতে সাঁতার জলের মত্ত নাচে।
এখনো কি ডাকার সাজে সাজেনি?
যে টেলিফোন বাজার কথা বাজেনি।

তৃষ্ণা যেন জলের ফোঁটা বাড়তে বাড়তে বৃষ্টি বাদল
তৃষ্ণা যেন ধূপের কাঠি গন্ধে আঁকে সুখের আদল
খাঁ খাঁ মনের সবটা খালি
মরা নদীর চড়ার বালি
অথচ ঘর দুয়ার জুড়ে তৃষ্ণা বাজায় করতালি
প্রতীক্ষা তাই প্রহরবিহীন
আজীবন ও সর্বজনীন
সরোবর তো সবার বুকেই, পদ্ম কেবল পর্দানশীন
স্বপ্নকে দেয় সর্বশরীর, সমক্ষে সে ভাসে না।
যে টেলিফোন আসার কথা সচরাচর আসে না।

রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

দুঃখ করো না, বাঁচো - নির্মলেন্দু গুণ

দুঃখকে স্বীকার করো না, –সর্বনাশ হয়ে যাবে ।
দুঃখ করো না, বাঁচো, প্রাণ ভ’রে বাঁচো ।
বাঁচার আনন্দে বাঁচো । বাঁচো, বাঁচো এবং বাঁচো ।
জানি মাঝে-মাঝেই তোমার দিকে হাত বাড়ায় দুঃখ,
তার কালো লোমশ হাত প্রায়ই তোমার বুক ভেদ করে
চলে যেতে চায়, তা যাক, তোমার বক্ষ যদি দুঃখের
নখরাঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়; যদি গলগল করে রক্ত ঝরে,
তবু দুঃখের হাতকে তুমি প্রশ্রয় দিও না মুহূর্তের তরে ।
তার সাথে করমর্দন করো না, তাকে প্রত্যাখান করো ।

অনুশোচনা হচ্ছে পাপ, দুঃখের এক নিপুণ ছদ্মবেশ ।
তোমাকে বাঁচাতে পারে আনন্দ । তুমি তার হাত ধরো,
তার হাত ধরে নাচো, গাও, বাঁচো, ফুর্তি করো ।
দুঃখকে স্বীকার করো না, মরে যাবে, ঠিক মরে যাবে ।

যদি মরতেই হয় আনন্দের হাত ধ’রে মরো ।
বলো, দুঃখ নয়, আনন্দের মধ্যেই আমার জন্ম,
আনন্দের মধ্যেই আমার মৃত্যু, আমার অবসান ।

মোনালিসা - নির্মলেন্দু গুণ

চোখ বন্ধ করলে আমি দেখতে পাই
সদ্য-রজঃস্বলা এক কিশোরীরে−
যে জানে না, কী কারণে হঠাৎ এমন
তীব্র তুমুল আনন্দ-কাতরতা
ছড়িয়ে পড়েছে তার নওল শরীরে।

মনুর ভাষায় গৌরী, এইটুকুনু মেয়ে
চমকে ওঠে নিজের পানে চেয়ে−
দেখে তার অঙ্গজুড়ে ফুলের উৎসব।
মনে হয় ছড়িয়ে পড়েছে মর্ত্যে
নার্গিস আর বার্গিসের স্বর্গপুষ্পঘ্রাণ।
মাকে ডেকে মেয়েটি শুধায়−
‘আমার শরীরে ফুলের সৌরভ কেন?
মেয়েরা বুঝি ফুলের উদ্যান?’

মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে মা বলেন,
‘বোকা মেয়ে, কিচ্ছু বোঝে না, −আয়,
আজ আমি কুসুমগরমজলে
তোকে নিজ হাতে গোসল করাব।’
মা’র বুকে মাথা পেতে মেয়েটি তখন
নিজেই কখন যেন মা হয়ে যায়।

এই লাভাস্রোত, এই সঙ্গকাতরতা
তাকে শেষে কোথায় ভাসিয়ে নেবে
জানে না সে; বোঝে না সে
তার বৃক্ষপত্রে কার হাওয়া লাগে?
অগ্নিকুণ্ডে বায়ুর মতন ছুটে এসে
কে তাকে জড়াবে আদরে, সোহাগে?

জানে না সে, বোঝে না সে তার চোখে,
ঠোঁটে, তলপেটে, ঘুমভাঙা স্তনে
জেগেছে যে ঢেউ তার গন্তব্য কোথায়?
আনন্দ পুরুষে? নাকি আনন্দ সন্তানে?

এইসব দেহতত্ত্ব জানার আগেই,
এইসব গূঢ় গোপন রহস্যভেদ
হওয়ার আগেই
আষাঢ়ের এক বৃষ্টিভেজা রাতে
মোনালিসার বিয়ে হয়ে গেল−
লিওনার্দো দা ভিঞ্চির সাথে।

লিওনার্দো অতঃপর দীর্ঘ রাত্রি জেগে
জীবনের শেষ রং দিয়ে
তাঁর প্রিয়তমা তরুণী ভার্যা
মোনালিসাকে ক্যানভাসে আঁকলেন।

শিল্পের ঔরসে মোনালিসা গর্ভবতী হলে
স্বর্গ থেকে মখলুকাতে পুষ্পবৃষ্টি হলো।
সিন্ধুর বিজয়রথ পশিল নদীতে−
শান্ত হলো ক্ষিপ্তোন্মত্ত সমুদ্রের জল।

মোনালিসা, য়ুরোপের প্রথম রমণী−
পুরুষের কাণ্ড দেখে হাসে।

শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

শেষ হ'ল জীবনের সব লেনদেন - জীবনানন্দ দাশ

শেষ হ'ল জীবনের সব লেনদেন,
বনলতা সেন।
কোথায় গিয়েছ তুমি আজ এই বেলা
মাছরাঙা ভোলেনি তো দুপুরের খেলা
শালিখ করে না তার নীড় অবহেলা
উচ্ছ্বাসে নদীর ঢেউ হয়েছে সফেন,
বনলতা সেন।

তোমার মতন কেউ ছিল কী কোথাও?
কেন যে সবের আগে তুমি চলে যাও।
কেন যে সবের আগে তুমি
পৃথিবীকে করে গেলে শূন্য মরুভূমি
(কেন যে সবার আগে তুমি)
ছিঁড়ে গেলে কুহকের ঝিলমিল টানা ও পোড়েন,
কবেকার বনলতা সেন।

কত যে আসবে সন্ধ্যা প্রান্তরে আকাশে,
কত যে ঘুমিয়ে রবো বস্তির পাশে,
কত যে চমকে জেগে উঠবো বাতাসে,
হিজল জামের বনে থেমেছে বুঝি রাত্রির ট্রেন,
শেষ হ'ল জীবনের সব লেনদেন।

শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

আকাশ - নির্মলেন্দু গুণ

আমার সমস্ত ভাবনা যখন তোমাকে ছোঁয়,
আমার সমস্ত উপলব্ধি যখন তোমার
আত্মাকে স্পর্শ করে, আমার সমস্ত বোধ
যখন তোমার বোধিতে নিমজ্জিত হয়,
তখন আমার প্রাণের গভীর থেকে
স্বতঃস্ফূর্ত মোহন মন্ত্রের মতো উচ্চারিত হয়
একটি অত্যন্ত সহজ শব্দ…"আকাশ"।

আমি শব্দটিকে ক্রমাগত উচ্চারণ করি।
জানি না কেন এ শব্দটিই শুধু
এত বারবার ঘুরে ঘুরে আসে।
জানি না কী পেয়েছে সে আমার ভিতরে?
আমি লক্ষ্য করেছি, ‘আকাশ’ শব্দটি
উচ্চারিত হওয়ার পরে আমার ভিতরে
আর কোন কষ্টই অবশিষ্ট থাকে না।
যেন যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বুলেটের মতো
আমার বুকের ভিতরে গেঁথে ছিল
এই যন্ত্রণাক্ত  আকাশ  শব্দটি।

তোমার আমার মাঝে আছে এরকম
বক্ষফাটা অনেক আকাশ । – আমি
ব্যর্থ প্রেমিকের মতো মুগ্ধমূর্খচোখে
কেবল তাকিয়ে থাকি আকাশের দিকে।

পূর্ণিমার মধ্যে মৃত্যু - নির্মলেন্দু গুণ

একদিন চাঁদ উঠবে না, সকাল দুপুরগুলো
মৃতচিহ্নে স্থির হয়ে রবে;
একদিন অন্ধকার সারা বেলা প্রিয় বন্ধু হবে,
একদিন সারাদিন সূর্য উঠবে না।

একদিন চুল কাটতে যাব না সেলুনে
একদিন নিদ্রাহীন চোখে পড়বে ধুলো।
একদিন কালো চুলগুলো খ’সে যাবে,
কিছুতেই গন্ধরাজ ফুল ফুটবে না।

একদিন জনসংখ্যা কম হবে এ শহরে,
ট্রেনের টিকিট কেটে
একটি মানুষ কাশবনে গ্রামে ফিরবে না।
একদিন পরাজিত হবো।

একদিন কোথাও যাব না, শূন্যস্থানে তুমি
কিম্বা অন্য কেউ বসে থেকে বাড়াবে বয়স।
একদিন তোমাকে শাসন করা অসম্ভব ভেবে
পূর্ণিমার রাত্রে মরে যাব।

একদিন সারাদিন কোথাও যাব না।

উপেক্ষা - নির্মলেন্দু গুণ

অনন্ত বিরহ চাই, ভালোবেসে কার্পণ্য শিখিনি।
তোমার উপেক্ষা পেলে অনায়াসে ভুলে যেতে পারি
সমস্ত বোধের উৎস গ্রাস করা প্রেম; যদি চাও
ভুলে যাবো, তুমি শুধু কাছে এসে উপেক্ষা দেখাও।

আমি কি ডরাই সখি, ভালোবাসা ভিখারি বিরহে?

শাঁখা - নির্মলেন্দু গুণ

আমি তোমাকে শাঁখা দিতে চাইলাম
তুমি চাইলে অর্থহীন সোনার কাকন।

আমি তোমাকে সংসার দিতে চাইলাম,
তুমি চাইলে সুসজ্জিত স্তব্ধ আকাশ।

আমি তোমাকে সন্তান দিতে চাইলাম,
তুমি চাইলে বাস্তবের বিদীর্ণ পলাশ।

আমি তোমাকে স্বপ্ন দিতে চাইলাম,
তুমি ঘুমের ওষুধ কিনে নিলে।

যাত্রাভঙ্গ - নির্মলেন্দু গুণ

হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে
মন বাড়িয়ে ছুঁই,
দুইকে আমি এক করি না
এক কে করি দুই।

হেমের মাঝে শুই না যবে,
প্রেমের মাঝে শুই
তুই কেমন করে যাবি?
পা বাড়ালেই পায়ের ছায়া
আমাকেই তুই পাবি।

তবুও তুই বলিস যদি যাই,
দেখবি তোর সমুখে পথ নাই।

তখন আমি একটু ছোঁব
হাত বাড়িয়ে জড়াব তোর
বিদায় দুটি পায়ে,
তুই উঠবি আমার নায়,
আমার বৈতরণী নায়।

নায়ের মাঝে বসবো বটে,
না-এর মাঝে শোবো,
হাত দিয়েতো ছোঁব না মুখ
দুঃখ দিয়ে ছোঁব।

তুই কেমন করে যাবি?